হঠাত কোলকাতা কেন গেলাম?
বলতে গেলে এমনি এমনি গিয়েছি, আবার বলা যায় অনেক কারনে গিয়েছি। আসলে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল থাইল্যান্ড। সুরভি আর আমি যাবো। দু'জনে মিলে খুব ঘুরে বেড়াবো। খুব দ্রুত সুরভির পাসপোর্ট করালাম। পাসপোর্ট করতে গিয়ে আরেক দিকদারির মধ্যে পড়লাম। পাসপোর্ট অফিস সেই পোস্তগোলা ব্রিজ পার হয়ে অনেকখানি দূরে। অথচ লেখা আছে যাত্রাবাড়ি জোনাল অফিস। পুলিশ ভেরিফিকেশনে এক হাজার টাকা দিলাম। পাঁচ শ' টাকা দিলেও হতো। লোকটাকে দেখে বেশ মায়া হলো। যদিও আমার কাগজ পত্রে কোনো প্রকার ঝামেলা নেই। যাই হোক, ইচ্ছা ছিল থাইল্যান্ড যাবো। তখন আব্বা বলল, কোলকাতা যা। আমি বললাম, কেন? আব্বা বলল ওখানে শিয়ালদহ'র কাছে বৈঠকখানা রোডে তোর দাদার বাড়িটা দেখে আয়। আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। শরীরটা ভালো থাকলে আমি তোদের সাথে যেতাম। আব্বার কথা মতো কোলকাতায়'ই গেলাম। ট্রেনের টিকিট কাটলাম। যেদিন রওনা দিব সেদিন ঘূর্নি ঝড় বুলবুল হানা দিল। টিকিট আগেই কাটা ছিল। তা না হলে যেতাম না। কোলকাতা আমার দাদার বাড়িটি এখন আমাদের হাতে নেই। ওরাই নিয়ে নিয়েছে। সেটা নিয়ে আমাদের কোনো আফসোস নেই।
ঢাকা কমলাপুর থেকে ট্রেন।
উদ্দেশ্য বেনাপোল। ট্রেন ছাড়ার কথা রাত ১২ টা ৪০ মিনিটে। অথচ সেই ট্রেন ছাড়লো রাত আড়াই টায়। আমার বাসার কাছেই কমলাপুর। হেঁটে গেলে বিশ মিনিট সময় লাগে। আমাদের দিয়ে আসতে জোর করে সাথে গেল আমার ছোট দুই ভাই। প্রায় দুই ঘন্টা স্টেশনে বসে থাকলাম। এত বড় স্টেশন অথচ ওয়াশ রুম খুঁজে পেলাম না। একটা ওয়াশরুম খুঁজে পেলাম সেটা আবার তালা মারা। তাহলে এত এত যাত্রী ওয়াশ রুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে, কোথায় যাবে? আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম প্রস্বাব কোথায় করবো? তারা বলল, কোনো চিপাচাপাতে করে দেন। চিপাচাপাতে পিসাব করা আমার পক্ষে সম্ভব না। এই কাজ আমি কোনো কালেও করি নি। অথচ অনেককে দেখেছি কোনো রকম দ্বিধা সংশয় ছাড়ায় রাস্তার মধ্যে প্রস্বাব করে দেয়। যাইয়া হোক, ট্রেনে উঠলাম। সুরভি খুব খুশি। সুরভির খুশি দেখে আমিও খুশি। সুরভির কাছে সব কিছুই ভালো লাগছে। গ্রাম থেকে শহরে কোনো মেয়ে প্রথম এলে যে রকম অবাক চোখে চারপাশ দেখে সুরভি'র সেই অবস্থা। সে কোনো কিছুতেই বিরক্ত হছে না। ট্রেন দুই ঘন্টা লেট, আমি চরম বিরক্ত অথচ সে হাসছে। সুরভি বলল, এই ট্রেনে বহু যাত্রী আছে। তারা তো তোমার মতো ট্রেন লেট করার কারনে বিরক্ত হচ্ছে না। তবে তুমি কেন বিরক্ত হচ্ছো? ট্রেনে ওঠার আগে দুইভাই ট্রেনে খাওয়ার জন্য কিছু খাবার কিনে দিয়েছি। সেই খাবার কোথাও হারিয়ে ফেলেছি।
বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন।
নতুন ট্রেন। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ট্রেন চলছে তুফানের মতোণ। মুহুর্তের মধ্যে ট্রেন বনানী পার হয়ে এয়ারপোর্ট চলে এলো। সুরভি ট্রেনের ক্যান্টিন থেকে সাসলিক আর কফি খেলো। ট্রেনের খাবার একেবারে ফালতু হয়। সামান্য চা-টা এরা ভালো বানায় না। অথচ দাম তিন গুন রাখে। বাইরে গেলে আমি বদলে যাই। সুরভি যা খেতে চায় মানা করি না। পানির মতোন টাকা খরচ করি। বড় বড় জংশনে ট্রেন থামে পাঁচ দশ মিনিটের জন্য। সুরভি আর আমি জটপট নামি। চা-টা খাই। আবার দৌড়ে উঠি। বাইরের খাবার যা দেখে সুরভি তা খাবেই। আমিও মানা করি না। ট্রেন যখন বেনাপোলের কাছাকাছি তখন আমাদের সামনে সিটে বসা দশজন ভারতীয় লোকজনের সাথে বেশ আড্ডা হলো। তারা আমাদের দেশে চিল্লায় এসেছেন। চার মাস মাগুরায় ছিলেন। এখন নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। দশজন হাজী হিন্দি ভাষায় আমাকে বললেন, আল্লাহর রাস্তায় নেমে যাও বন্ধু। দেশে দেশে ঘুরে আল্লাহর কথা বলুন, নবীর কথা বলুন। আমি বলাম, বউ বাচ্চা রেখে আমি পথে পথে ঘুরবো? এক জায়গায় বসে আল্লাহকে ডাকলে হবে না? তখন মজিদ নামের একজন বললেন, তোমার বউ এর চেয়ে আমার বউ বেশি সুন্দর। আমি তাকে রেখে এসেছি। আমার ছোট বাচ্চাটাকে রেখে এসেছি। বছরে আট মাস পরিবারকে সময় দাও, কর্ম করো। চার মাস আল্লাহর রাস্তায় থাকো। চিল্লায় আসা ভারতের ইউপি'র লোকজন পরম মমতায় আমার হাতে বেশ কয়েকবার চুমু খেলো। সকাল দশ'টায় আমাদের ট্রেন বেনাপোল থামলো। বেনাপোল নেমে আমি আর সুরভি এক রেস্ট্রুরেন্টে ইলিশ মাছ দিয়ে গরম ভাত খেয়ে নিলাম।
বাংলাদেশ পার হয়ে ভারতে পা রাখলাম।
বেনাপোলে অসংখ্য দালাল। তারা নানান রকম কথা বলছে। আমি তাদের কোনো কথা কানে নিই নি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হলাম। কোনো ভিড় ছিল না। সব মিলিয়ে দুই মিনিট লাগলো। পাসপোর্টে একটা সিল দিয়ে দিল। ভারতীয় ইমিগ্রেশনেও কোনো ঝামেলা হলো না। তবে তাদের ১০০ টাকা দিতে হলো। একলোক বিশাল এক প্লাস্টিকের ঝুড়ি নিয়ে বসে আছেন। সেটা ভর্তি টাকা। ভারতে পা রাখা মাত্র নানান ধরনের দালাল ঘিরে ধরলো। কেউ বলছে তাদের ভালো বাস আছে, কোলকাতা নামিয়ে দিবে অল্প টাকায়। কেউ বলছে টাকা ভাঙ্গিয়ে নিন বেশি রেট দিব। কেউ ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলছে তাদের কোলকাতার হোটেলে উঠতে। আমি দালালদের সাথে কোনো কথা না বলে, দেশ ট্রাভেলস এর বাসের কাউন্টারে গিয়ে কোলকাতা নিউ মার্কেট যাবার দু'টিকিট কেটে নিলাম। তারা জনপ্রতি টিকিট বিক্রি করছে ২৮০ টাকা করে। অথচ আমার কাছ থেকে নিলো ২০০ টাকা। তবে বাসটি অনেক দেরীতে ছেড়েছে। দেরীতে ছাড়াতে আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। এই ফাঁকে আমি বনগাঁ রেলস্টেশন ঘুরে এসেছি। মানি এক্সচেঞ্জ এর দোকানে গিয়ে আমাদের দেশের এক হাজার টাকা দিলাম। তারা আমাকে ৮৩০ ভারতীয় রুপী দিলো। আমার কাছে অবশ্য আগে থেকেই কিছু ভারতীয় টাকা ছিল। সেখানে আমরা চা-টা খেলাম। জুস কিনলাম, চিপস, পানির বোতল কিনলাম।
বাস খুব ধীরে চলছে।
যাত্রী না থাকার কারনে বাস অনেক দেরীতে ছাড়লো। ছোট রাস্তা। বাস চলছে তো চলছেই। বনগাঁ ঘেষে, উত্তর ২৪ পরগনার পথ ধরে। এর মধ্যে আমাদের সামুর ব্লগার পদাতিক চৌধুরী দাদার সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। উনি অসংখ্য বার ফোণ দিয়েছেন। খুব খোজ খবর নিয়েছেন, প্রতিনিয়ত খোজ খবর নিয়েছেন। উনার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। সুরভি আরো বেশি মুগ্ধ! সুরভি বলল, উনি এত ভালো মানুষ কেন! (পদাতিক দাদার কথা আলাদা পোষ্ট দিয়ে বিস্তারিত বলব।) যাই হোক, ট্রেনে করে বেনাপোল আসার সময় যেই ভারতীয় হুজুরদের সাথে আমার গল্প হয়েছিল। তারাও এই বাসে উঠলো। সুরভি আমাকে সাবধান করে দিলো, যেন হুজুরদের বক বক না করি। উত্তর ২৪ পরগনার রাস্তা আর শেষ হয় না। রাস্তার দুই পাশে গ্রাম আর রাস্তাঘাট দেখে দেখে চোখ ক্লান্ত। এর মধ্যে বাসের সুপারভাইজার সাহেব যাত্রীদের কাছে ইন্ডিয়ান সিম বিক্রি করছেন। চার শ' বা তিন শ' টাকা করে- সঠিক মনে নেই। সেই সিম নিলে অনেক সুবিধা। কি কি সুবিধা তা তিনি দুই হাত নেড়ে চোখ বড় বড় করে বলছেন। বেশ কয়েকজন যাত্রী সিম কিনে নিলো। বাসে আমাদের একটা করে পানির বোতল দিলো। একটা রেস্টুরেন্টে বাস থামলো। সেখানে কিছু খাওয়া দাওয়া করলাম। মাটির ভাড়ে চা খেলাম। রাত আট টায় কোলকাতায় বাস থামলো।