আমার নানী বিরাট ব্যবসায়ী ছিলেন।
তার বাড়ি বিক্রমপুর হলেও উনি ব্যবসা করতেন কোলকাতা আর আসামে। পিতলের ব্যবসা ছিলো নানীর। পিতলের থালা, বাটি, গ্লাস সব তিনি তার কারখানায় বানাতেন। সেই সময় ধনী মানুষেরা পিতলের থালা বাটি ব্যবহার করতেন। নানী পিতলের ব্যবসায় খুব ভালো করে ফেললেন অল্প সময়ে। পিতলের ব্যবসার পাশাপাশি তিনি শাড়ি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলেন। শাড়ি কাপড়ের ব্যবসায়ও তিনি অল্প সময়ে খুব নাম করে ফেললেন। দেদারসে টাকা আসতে লাগলো। কিন্তু তাকে ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসতে হলো। ইন্ডিয়ার সরকার বাধ্য করলো দেশে ফিরে আসতে।
নানী ঢাকার ইসলামপুরে জমি রাখলেন।
ঢাকা গিলগাও এলাকায় জমি কিনলেন। দুই জায়গায় বাড়ি বানালেন। দশটা নতুন বেবিটেক্সি কিনলেন। ইন্ডিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে নানী ঢাকায় একাই পুরো ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে গেলেন। নানা, নানীকে কোনো রকম সহযোগিতা করেন নি। নানা থাকেন ফুটবল খেলা নিয়ে, চায়ের দোকানে আড্ডা নিয়ে। আর সারাদিন কানের কাছে রেডিও ধরে। তৎকালীন ভারত সরকারের কারনে ব্যবসা গুটিয়ে চলে আসতে নানীর খুব কষ্ট হয়েছে। ঢাকায় ব্যবসার পরিসর ছোট হয়ে গেল। নানীর কোনো ছেলে নাই। তার শুধু দুই মেয়ে। ইন্ডিয়া থেকে ফিরেই বড় মেয়ের বিয়ে দিলেন পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ীর সাথে।
শেষ বয়সে নানী ধর্মের দিকে ঝুঁকলেন।
ধর্মের দিকে ঝুঁকে নানীর ব্যবসা লাটে উঠলো। দশটা বেবিটেক্সি কে বা কারা নিয়ে গেল। পিতলের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। কাপড়ের ব্যবসা নানা দেখাশোনার দায়িত্ব নিলো। এবং তিন মাসে ব্যবসা লস খেয়ে আরো ঋণ করতে হলো। নানীর সেদিকে নজর নেই। তিনি সারাদিন মাজারে মাজারে পড়ে থাকেন। নানী চুল আচড়ানো ছেড়ে দিলেন। চুলে বিকট জট লেগে গেলো। নানী নানান রকম মালা গলায় পড়ে থাকতেন। কাউকে কিচ্ছু না বলে আজমী শরীফ চলে যেতেন। মাসের পর মাস থাকতেন। আমার মা তখন অনেক ছোট। ইসলামের পুরের বাড়ি দখল করে নিলো আমাদের দূর সম্পর্কের মামা'রা।
নানী ছিলেন সহজ সরল মানুষ।
এই মানুষ ধর্মের জগতে প্রবেশ করে অনেকটা পাগল হয়ে গেলেন। আজমী শরীফ থেকে নানান রকম পীরবাবা নানীর কাছে আসতে লাগলেন। তাদের যাতায়াতের খরচ এবং থাকা খাওয়া সব নানীর। পীরবাবার পা ধুয়ে দিতেন আমার নানী। পীরবাবা যা বলেন নানী তাই করেন। নানী একটা ভ্যানগাড়ি কিনলেন। প্রতি সপ্তাহে দুইবার বাবুর্চি দিয়ে এক শ' জনের খিচুড়ী রান্না করে মিরপুর মাজারে নিয়ে যান। মাজারের পাগলের নিজ হাতে খাওয়ান। ব্যবসা বন্ধ। এবং জমানো টাকা শেষের দিকে। আছে শুধু গহনা। এই গহনাও যাদের কাছে রাখা হয়েছে, নানীর মৃত্যুর পর তারা অস্বীকার করেছে।
পীরবাবা বলেছেন, তিন তার পোষা দু'টা জ্বীন নানীকে দিয়েছেন।
বাস্তবে জ্বীনের কোনো কার্যকারিতা দেখা গেল না। এলাকার মানুষ নানীকে বোকা বানিয়ে টাকা এবং গহনা নিতে শুরু করলো। একজন এসে বলল, আজমী শরীফ গিয়েছিলাম। এই ফুল গুলো বালিশের নিচে রেখে ঘুমান। সকালে উঠে দেখবেন, ফুল গুলো তজবি আর জায়নামাজ হয়ে গেছে। এদিকে আজমী শরীফের পীর বাবা নানীকে বলে গিয়েছেন, উনি দু'টা জ্বীন নানীকে দেখাশোনা করার জন্য রেখে গেছেন। নানীর কোনো বিপদআপদ হবে না। এমন কি শরীর খারাপ হলেও জ্বীনরা দেখবে। নানীর শরীর খুব খারাপ হলো। কিন্তু নানী ডাক্তার দেখান না। নানীর বিশ্বাস পীরবাবার জ্বীনরা নানীকে সুস্থ করে তুলবে। বিনা চিকিৎসায় নানী মারা গেলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:১৬