লেখকদের অনেক কিছুই থাকতে হয়।
একজন লেখকের ধার থাকতে হয়, তেজ থাকতে হয়, ব্যক্তিত্ব থাকতে হয়, সাহস থাকতে হয়, সত্য বলার ক্ষমতা থাকতে হয়, স্বচ্ছ-পবিত্র জ্ঞান থাকতে হয় এবং সর্ব্বোপরি 'গল্প' বলতে জানতে হয়। তাহলেই একজন লেখক অনেক দূর যেতে পারবেন। আমি মনে করি, হাবিবুল্লাহ ফাহাদের মধ্যে একজন শক্তিশালী লেখক হওয়ার সকল গুনাবলি বিদ্যমান আছে। লেখালেখির ক্ষেত্রে বয়স কোনো ব্যাপার না। কেউ ত্রিশ বছরে যে জ্ঞান অর্জন করে, সেই জ্ঞান কেউ ষাট বছরে অর্জন করে। আমি বিনা দ্বিধায় বলে দিতে পারি, হাবিবুল্লাহ ফাহাদ তার যোগ্যতা দিয়ে, তার সমস্ত মেধা দিয়ে, সমস্ত ভালোত্ব দিয়ে বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিবেন।
'বজলু জানে লাশের পরিচয়' গ্রন্থে বারোটি গল্প আছে।
প্রতিটা গল্প'ই ভিন্ন স্বাদের। এবং প্রতিটা গল্প অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। পাঠকেরা এরকম গল্পই পড়তে চায়। সহজ সরল ভাষা। কোনো ভনিতা নেই। গল্পের পাশাপাশি শব্দের গাঁথুনি এবং চারপাশের বর্ননা আমাকে মুগ্ধ করেছে! লেখক তার প্রতিটা গল্পের সময়, সময়ের নিখুঁত বনর্না এবং প্রকৃতির বর্ণনা যেভাবে দিয়েছেন- তাতে প্রকৃতির কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ কথা মনে করিয়ে দেয়। একটা গল্পকে দাঁড় করাতে গল্পের থিমের চেয়ে চারপাশের বর্ণনা অধিক গুরুত্বপূর্ন। লেখক হাবিবুল্লাহ ফাহাদের সেদিকে বেশ নজর আছে। গল্প গুলো পড়লেই বুঝা যায় লেখক প্রচন্ড পরিশ্রমী। এবং আত্মবিশ্বাসী।
'বজলু জানে লাশের পরিচয়' গল্পটি মূলত মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেক বড় সম্পদ। সুখে দুঃখে আমাদের বারবার ৭১ এ ফিরে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহস দেয়, শক্তি দেয়, দেশকে ভালোবাসতে শেখায়। লেখক মুক্তিযুদ্ধ দেখেন নি। যুদ্ধের অনেক পড়েই তার জন্ম। কিন্তু দেশ এবং দেশের মানুষের উপর লেখকের সীমাহীন ভালোবাসা রয়েছে। অবশ্য মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা না থাকলে লেখক হওয়া যায় না। লেখক দেশ নিয়ে ভাবেন, দেশের মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তিত। হুমায়ূন আহমেদ বা আল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধ করেন নি। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মহৎ সব উপন্যাস লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি লেখকের বিশাল দূর্বলতা আছে, ভালোবাসা আছে।
'বজলু জানে লাশের পরিচয়' গল্পটি নিয়ে দু'টা কথা বলি।
গল্পের শুরু এভাবে- একজন হিন্দু লোককে বলা হয় আজান দিতে। যাকে আজান দিতে বলা হলো- তার নাম হরিপদ। হরিপদকে অনেক মারধোর করা হয়েছে। তার ঠোট কেটে রক্ত পড়ছে। হরিপদের গলা শুকিয়ে কাঠ। হরিপদ পানি চাইতেই তাকে শরবতের কথা বলে নোংরা ডোবা থেকে পানি এনে দেওয়া হয়। মেজর সাহেব এলে তার আসল বিচার হবে। মেজর সাহেব অলরেডি রওনা দিয়ে দিয়েছেন। হরিপদ তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে তিনি যান নি। বাপ দাদার ভিটা ছেড়ে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় নি। 'বজলু জানে লাশের পরিচয়' গল্পটি পড়ার পর মনে হবে- বইটির নামকরণ সার্থক হয়েছে।
লেখক হাবিবুল্লাহ ফাহাদ গল্পের শেষটা বেশ রহস্যময় করে তুলেছেন। হরিপদকে কি ছেড়ে দেওয়া হয়? যদি ছেড়েই দেওয়া হয় তাহলে খালে একটা মন্ডুবিহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুরো শরীর পানিতে ফুলে উঠেছে। পচতে শুরু করেছে। মন্ডুবিহীন কার লাশ এটা? বইটি পড়ুন। গল্প গুলো উপভোগ করুন। আমার মতো আপনারা মুগ্ধ হবেন। 'বজলু জানে লাশের পরিচয়' বইটি শেষ করে আপনার ভালো লাগবে। বইটা পড়তে পড়তে কখনও কখনও বুক হাহাকার করে উঠবে, আবার আনন্দে নেচে উঠবে মন। বেদনার্ত হবেন। পাওয়া না পাওয়ার শিখরে উঠবেন-নামবেন, স্বপ্ন দেখবেন, হতাশা কেটে যাবে, আশা জাগবে বুকের গভীরে। একবারও মনে হবে না- বইটি পড়ে সময় অপচয় করা হলো। সম্পূর্ন বইটি শেষ করার পর আপনার মনে হবে- জীবন আনন্দময়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:০৭