একবার এক ইংরেজ কালেক্টরের সামনে দিয়ে রামমোহন পাল্কিতে চড়ে যাচ্ছিলেন- এতে কালেক্টর স্যার ফ্রেডারিক খেপে গেলেন। কারণ ইংরেজ সাহেব দাঁড়িয়ে আছে আর একজন দেশী কিনা পাল্কীতে চড়ে যাচ্ছে! তিনি চিৎকার করে রামমোহনকে পাল্কী হইতে নামতে বলেন কিন্তু রামমোহনও ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। তিনি ইংরেজ সাহেবকে বুঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু কালেক্টর সাহেব যখন বুঝতে চাইলেন না। তখন রামমোহন পাল্কীতে চড়ে দ্রুত চলে গেলেন। এবং এই অপমানের প্রতিকারের জন্যে রামমোহন বড়লাটকে প্রতিবাদ জানান। ধারণা করা হয়, এই প্রতিবাদ চিঠি ছিল রামমোহনের প্রথম ইংরেজি রচনা। এতে অবশ্য কাজও হয়েছিল। কালেক্টর স্যার ফ্রেডারিকের উপর আদেশ হয়েছিল-দেশীয় লোকদের সাথে ভবিষ্যতে যেন এমন বচসা না করেন।
রামমোহন রায় একজন বাঙালি দার্শনিক।
তিনি বিখ্যাত হয়েছেন, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য। রামমোহন রায় ১৮২৮ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। রাম মোহন একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। সব ধর্মের প্রকৃত সত্য সবাইকে জানানোর জন্যই নানা ভাষায় বই লিখতে শুরু করেন। হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করতে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়গণের মধ্যে ধর্মগত ভেদাভেদ দূর হবে।
এক হিসাবে দেখা যায়, ১৮১৫ থেকে ১৮১৮ চার বছরে প্রায় আড়াই হাজার মেয়েকে স্বামীর সাথে পোড়ানো হয়েছিল। অল্প বয়সী বিধবা মেয়েদের এই করুন পরিনতি তাকে প্রচন্ড কষ্ট দেয়। রামমোহন অসংখ্য সতীদাহ দেখেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন এই প্রথা সমাজের এক অভিশাপ। অনেকের অভিমত ১৮১২ সালে তাঁর বৌদিকে সহমৃত হতে দেখে প্রথম এর বিরুদ্ধে তাঁর মনে ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিল। তখন থেকেই তিনি এই প্রথা উচ্ছেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রামমোহন ইউরোপের ইতিহাস পাঠ করে বুঝতে পারলেন, দেশের মানুষের উন্নতির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন শিক্ষার বিস্তার, জাতীয় চেতনার প্রসার, সমাজ রাষ্ট্র সম্বন্ধে সম্যক ধারণা। দরিদ্র লোকদের শিক্ষাই সম্পদ।
পলাশীর যুদ্ধের পনেরো বছর পরে এবং ফরাসি বিপ্লবের ঝড়ের মুখে ভারত বর্ষে ২২ মে, ১৭৭২ সালে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত ও কুলীন হিন্দু পরিবারে। বাবা রামকান্ত রায় এবং মা তারিণী দেবী। গ্রামের পাঠশালাতেই তাঁর বাল্যশিক্ষার শুরু। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। ৯ বছর চাকুরী করে বেশ অর্থ উপার্জন করার ফলে অর্থনৈতিকভাবে তিনি বেশ সমৃদ্ধশালী ছিলেন। রামমোহনের বই ও বইয়ের অনুবাদের ফলে দেশে বিদেশে রামমোহনের নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লন্ডন, ফ্রান্স, আমেরিকায়ও রামমোহন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে ভারতে রামমোহনের বিরুদ্ধে দেশে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়।
রামমোহন বলিষ্ঠ পুরুষ ছিলেন।
শরীরের দৈর্ঘ্য ছিল ছয় ফুট উচ্চ। মাথা ছিল অস্বাভাবিক বড়। এই জন্যে বিলেতের বিশেষজ্ঞগণ তাঁকে অসাধারণ পুরুষ বলত। রামমোহন প্রতিদিন ১২ সের দুধ পান করতেন। কথিত আছে, একবারে একটি আস্ত পাঠার মাংস খেতে পারতেন। কলিকাতায় তিনি যখন ধর্মমত প্রচার যখন শুরু করেন তখন কিছু মানুষ তাকে একাধিকবার হত্যার পরিকল্পনা করে। এই কথা শুনে রামমোহন বললেন- আমাকে মারবে? কলকাতার লোক আমাকে মারবে? তারা কী খায়?’’ এই কথার মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয়, রামমোহনের নিজের শক্তি-সামর্থ্যের উপর যথেষ্ট আস্থা রাখতেন। রামমোহন শরীরের বিষয়ে বেশ যত্নবান ছিলেন। তিনি শরীরকে ভগবানের মন্দির মনে করতেন। সেই কালের অন্যদের মতন তাঁরও বাবরী চুল ছিল। রামমোহন যেমন খেতে জানতেন তেমনি পড়তে পারতেন। শোন যায়, রামায়ণ-এর মতন মহা-গ্রন্থ তিনি এক বসাতে শেষ করে ফেলতেন।
রামমোহন ছিলেন বহুভাষাবিদ।
মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি দশটি ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন। রামমোহন মোট ১০টি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন-সংস্কৃত, পারসি, আরবি, উর্দু, বাংলা, ইংরেজি, ফরাসী, ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু। এসকল ভাষার প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রতিদিন গোসল করার সময় কবিতা আবৃত্তি করতেন। একবার তিনি মধু দিয়ে রুটি খেতে খেতে বালক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলছিলেন-বেরাদর (পারস্য শব্দ ভাই), আমি মধু ও রুটি খাচ্ছি, কিন্তু লোকে বলে আমি গরুর মাংস ভোজন করে থাকি। সামাজিক কুৎসা, জীবনের উপর আক্রমণ সবকিছুই সইতে হয়েছে রামমোহনকে। তৎকালীন সমাজিক প্রথানুসারে বাবার নির্দেশে রামমোহনকে নয় বছর বয়সের মধ্যেই তিনবার বিয়ে করতে বাধ্য হোন। প্রথম স্ত্রী কিছুদিনের মধ্যে মারা যান। নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই পরবর্তী জীবনে তিনি বহু বিবাহ প্রথার তীব্র নিন্দা এবং বিরোধিতা করেন। এমনকি তিনি তাঁর পুত্রদের ওপর শর্ত আরোপ করেন যে, স্ত্রী বেঁচে থাকতে যদি কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করে তাহলে সে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ পুরুষের একাধিক বিয়েকে স্ত্রী লোকদের জন্যে হীন ও অসম্মান হিসেবে তিনি দেখতেন।
প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের অত্যাচার সহ্য করার পরও রামমোহনের কোন লেখায় কারো প্রতি কোন বিদ্বেষ দেখা যায়নি। কলকাতায় যখন ব্রাহ্মসভায় উপাসনা করতে যেতেন তখন লোকে তার গাড়িতে ঢিল ছুড়ত। তাই বেশির ভাগ সময় গাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হতেন। বিরোধী পক্ষ তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করছে। এই জন্যে রামমোহন তাঁর সঙ্গে কিরিচ ও পিস্তল সঙ্গে নিয়ে বের হতেন। কিন্তু এর পরও তিনি এসব নিয়ে রসিকতাই করতেন। সহিষ্ণুতার নীতিতে ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। তাই তিনি ভারতপথিক। মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনের মাটিতেই ব্রিস্টলে ১৮৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। রামমোহনের জীবনের শেষ তিন বছর কেটেছিল ইংল্যান্ডে। ঊনষাট বছর বয়সে বিদেশের মাটিতেই মারা যান ভারতের প্রথম আধুনিক পুরুষ।
রাজা রামমোহনকে নিয়ে মেরি কার্পেন্টার ‘লাস্ট ডেজ অফ রামমোহন রায়’ নামে একটি বই লিখেন। বইটি বেরোয় ১৮৬৬–তে, রাজার মৃত্যুর ৩৩ বছর পরে। আর দ্বিতীয় যে বইটি রামমোহন কেন আধুনিক ভারতের প্রথম অগ্রদূত সম্পর্কে চোখ ধুইয়ে পরিষ্কার করে সেটি হল ‘লাইফ অ্যান্ড লেটারস অফ রামমোহন রায়’। লেখিকা সোফিয়া ডবসন কলেট। ১৯০০ সালে রাজার মৃত্যুর ৭৭ বছর পরে বইটি প্রকাশিত হয়।
এক নজরে রামমোহনঃ
# ১৭৭২ সালে রামমোহন এর জন্ম।
# ১৮০৩ সালে রামমোহন এর পিতা রামকান্ত রায়ের মৃত্যু হয়।
# ১৮০৫ সালে রামমোহনের বন্ধু মিঃ ডিগবি রামগড়ের ম্যাজিষ্ট্রেট হলে রামমোহনকে সরাসরি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরী দেন।
# ১৮১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে রামমোহন কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন
# ১৮১৫ সালে রামমোহন ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের মত প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।
# ১৮১৬ সালে রামমোহনের গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ দেখে ইংরেজ পাদ্রীরা অবাক হোন।
# ১৮১৮ সালে সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন রামমোহন।
# ১৮১৯ সালে আত্মীয় সভা বিহারীলাল চৌবের বাড়িতে স্থানান্তরিত করেন রামমোহন।
# ১৮২০ সালে রামমোহন প্রকাশ করেন তাঁর আলোচিত গ্রন্থ: জিশু খ্রিস্টের উপদেশ-শান্তি সুখের পথ (Precepts of Jesus-Guide to Peace and Happiness)।
# ১৮২১ সালে রামমোহন সম্বাদ কৌমুদী নামে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।
# ১৮২২ সালে মিরাত-উল-আখবার নামে ফারসি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন রামমোহন।
# ১৮২৩ সালে রামমোহন প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষার বিরোধিতা করে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব দিয়ে লর্ড আমহাস্টকে চিঠি লেখেন।
# ১৮২৮ সালে রামমোহন ব্রাহ্মসভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্মসমাজ) অর্থাৎ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন,
# ১৮২৯ সালে রামমোহন দিল্লীর বাদশাহ থেকে রাজা উপাধি লাভ করেন।
# ১৮৩০ সালে ১৯ নভেম্বর রামমোহন কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন।
# ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন রামমোহন।
# ১৮৩২ সালে শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য রামমোহন ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন।
# ১৮৩৩-সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিস্টলে তাঁরামমোহনের মহাপ্রয়াণ হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২০ দুপুর ১২:০৮