'হারামজাদী ছিনাল
বজ্জাত মাগী
খানকী বেইশ্যা
মিয়া বাড়ির কাচারির সুমুখে লম্বালম্বি মাঠ। মাঠের পর মসজিদ। সে মসজিদের সুমুখে বসেছে বাদ-জুমা মজলিস। খানিক দূরে দাঁড়ান ঘোমটা ছাড়া একটি মেয়ে। গালি গুলো ওরই উদ্দেশ্যে। এসব গালি আমি দেই নি। শ্রদ্ধেয় শহীদুল্লাহ কায়সার তার 'সংশপ্তক' গ্রন্থের প্রস্তাবনা করেছেন এই অমৃত বাণী দিয়ে।
কথায় আছে, 'কোন ভাষা আয়ত্ত করতে সেই ভাষার গালি গুলো আগে জানতে হবে'! ভারতবর্ষের এক একটি রাজ্যে গালি প্রবণতা একেক রকমের। কোন কোন রাজ্যে খুব কম গালি দেওয়া হয়। আবার যেমন হরিয়ানা রাজ্যে গালি ছাড়া কোন বাক্যই যেন অসম্পূর্ণ। হরিয়ানভি ভাষায় এমন বয়স্ক মানুষের সাথে যখন কথা বলে তখনো গালি দেওয়ার রীতি আছে। যাই হোক, নিজের দেশের কথা বলি, ছোটলোক শব্দটা আমরা গালিগালাজ হিসাবে ব্যবহার করি। 'শালা' একটা গালি কিন্তু বৌয়ের ভাইয়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ আপনাকে গালি দিলে আপনি যদি চুপ থাকেন তাহলে সে কিছুক্ষণ পরে সবচেয়ে বেশি অপমানিত বোধ করবে। সর্বপরি ক্ষমা হচ্ছে মহৎ গুণ, যে মানুষকে ক্ষমা করে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন। এইসব বিষয় বিবেচনা করে আপনাকে যদি কেউ গালি দেয়, আপনি তাঁকে ক্ষমা করে দিবেন।
'মালাউন’ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের পর থেকে আমাদের দেশের কিছু মানুষের মুখে ‘মালাউন’ শব্দটির ব্যবহার দ্রুতহারে বাড়তে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বেশির ভাগ উর্দুভাষী পাকিস্তানী হিন্দু শব্দের পরিবর্তে ‘মালাউন’ শব্দটি ব্যবহার করতে থাকে। বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বীদের কোনো ক্রমেই ‘মালাউন’ বলা উচিত নয়। সংস্কৃতিবান, সুশিক্ষিত, অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত চেতনার ধারক, আধুনিক মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই ‘মালাউন’সহ কোনো প্রকার বাজে শব্দের অপপ্রয়োগ শুধু অসম্ভবই নয়, অভাবনীয়ও বটে। ইংরেজীতে 'Bastered' আর বাংলায় 'জারজ'। আমার মনে হয় না যে এর চাইতে নিকৃষ্ট গালি এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর আছে। রাগ আমাদের সবারই হয়, ঝগড়াও হতে পারে, কিন্তু গালাগালি দেওয়া তার সমাধান নয়।
আমি গালি দেই না, আর কেউ দিলে পছন্দও করিনা।
যে ব্যাক্তি গালি দেয়াকে আর্ট হিসেবে নেয় সে একজন আদর্শ মূর্খ। আর 'পড়ালেখা করলেই মূর্খতার থেকে বের হওয়া যায় না। পড়ালেখার সাথে নৈতিকতা ও মুল্যবোধের শিক্ষাই একজন মানুষকে আসল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারে'। সমাজে এমন মূর্খও আছে যারা গালি দিতে জানে ঠিকই কিন্তু সেটার অর্থও জানে না। যারা 'বিদেশে পাড়ি জমানোর দু'দিন না যেতেই বাংলাদেশকে গালি দেন' তারা মূলত নিজের দেশকে প্রতিনিয়তই সেই দেশের বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর সিস্টেমের সাথে মনের অজান্তেই তুলনা করে ফেলেন। একটা শিশু যখন একটু বড় হবে চারপাশের মানুষের সাথে মিশবে তখন সে গালি দেওয়াও শিখে যাবে। তাই আশাপাশের কেউ যেন গালিগালাজ না করে সেজন্য সচেতন হতে হবে। গালি দেওয়া ভাল কাজ নয় এটা শিশুকে বুঝাতে ও শিখাতে হবে।
কোরআনে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করা নিষেধ আছে।
আসলে, বিক্ষুব্ধ মানুষটির ভেতরে ঘুরতে থাকা ক্ষোভ কখনো কখনো গালি হয়ে বেরিয়ে যায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। গালি বৈচিত্র্য বাঙালিদের মধ্যেই বেশি। গালির কত যে রঙ, কত যে রূপ, কত যে বাহার! আপনাকে গালি দিলে যদি আপনি মনে করেন আপনার মানহানি ঘটেছে তবে আপনি আদালতে গালিদাতার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারেন। গালির সঠিক উৎপত্তি ঠিক কোথায় এবং কিভাবে তার স্বপক্ষে কোন তথ্য পাওয়া যায় না! তবে একথা সত্য, মানুষ গালি কিংবা তথাকথিত কুরুচিপূর্ন শব্দ ব্যবহার করে মানসিক প্রশান্তি পায়। মিডল ফিঙ্গার মূলত একটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার ইংরেজি গালি Fu*k you. মুরুব্বীরা বলেন, কাউকে গালি দেয়া কবিরা গুনাহ তথা মারাত্মক পাপের কাজ।
তসলিমা নাসরিন বলেছেন, 'কোনো শব্দই অশ্লীল নয়'!
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন ধারা পদ্য! এই পদ্যেই বেশ প্রসিদ্ধ কিছু কবির জনপ্রিয় কবিতা গুলোতেই খুঁজে পাওয়া যায় গালির ব্যবহার! যেমন- হারামজাদা', 'চুতমারানি', 'বেশ্যা', 'খানকি', 'বাল', 'আবাল', 'যোনিকেশ', 'স্তন', 'নিতম্ব', 'লিঙ্গ' সহ আরো অশ্লীল শব্দের ব্যাবহার লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, নির্মলেন্দুগুন, রফিক আজাদ, হেলাল হাফিজ, রুদ্র শহীদুল্লাহ সহ অনেকেরই কবিতায়! অবশ্য রবীন্দ্র বা নজরুল একটু ভদ্রভাবে গালি দিতেন- যেমন 'কূপমন্ডুপ', 'বাত্তেমিজ'! ঢাকায় প্রচলিত গালি গুলো হচ্ছেঃ শালা, হারামি, কুত্তার বাচ্চা, শুয়োর, শুয়োরের বাচ্চা, মাদারি, চুদিরভাই, বাল, চুদলাম না, মাগি, বেশ্যা, রাজাকার, খানকি, চুনু, বদমাশ, পাঠা, ছাগল, গাধা, বোকাচোদা, হারামজাদা, ভোদাই, হেডা, বদমাশ ইত্যাদি।
কেউ একজন আপনাকে বাজে শব্দে ডাকছে বা লিখছে অথচ সেসব আপনি গায়ে মাখছেন না- তখন সেসব গালিগুলো পাত্তা পাবে না! আপনি গালি গুলোকে খারাপ ভাবে নিলেই খারাপ, ভালো ভাবে নিলেই সেটা অনেকাংশেই ভালো! গালি কখনো কখনো আদরার্থেও ব্যবহৃত হয়! যৌন মিলনের সময় কিছু অশ্লীল শব্দ পুরুষ- নারী একজন অপরজনকে বলতে থাকে। শুনেছি এতে নাকি কামোত্তেজনা বহুগুনে বৃদ্ধি পায়! কেউ গালি দিলে চুপ থাকার চেষ্টা করুন। সময় হলে আপনার যোগ্যতা তার গালির উত্তর দিয়ে দিবে। হযরত আলী রাঃ বলেছেন, নীচু লোকের হাতিয়ার গালি। যদি কোন লোক তোমাকে খারাপ কথা বলে, তবে তার কথার জবাব দিও না। কেননা, হতে পারে এর চেয়েও খারাপ কোন বাক্য তার ঠোঁটের কাছেই রয়েছে। তুমি ওর কথার জবাব দেয়ার সাথে সাথেই সে তা বলতে শুরু করবে।
অনেকে বলে থাকেন, জনপ্রিয়তার নির্দেশক হলো বিদ্বেষমূলক মন্তব্য/কথাবার্তা। যাকে লোকে যত বেশি গালি দেয়, সে হচ্ছে ততই জনপ্রিয়। এই কথা আমি মানি না। ছোটবেলা আমি মিলি তুলি আপার কাছে পড়তে যেতাম। আমাদের বাসার কাছেই তাদের বাসা। মিলি তুলি আপা ছিলেন দুই জমজ বোন। দেখতে ভীষন মিষ্টি ছিলেন। একদিন রাস্তায় আমি খেলছিলাম। তখন এক ছেলের সাথে আমার ঝগড়া হয়ে যায়। আমি রেগে গিয়ে ছেলেটাকে 'কুত্তার বাচ্চা' বলে গালি দিয়ে দেই। এমন সময় এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন মিলি তুলি আপা। উনারা আমার গালি শুনে ফেলেন। সেদিন সন্ধ্যায় পড়তে যাওয়ার পর দুই বোন আমাকে ধরলেন। বললেন, এত কুৎসিত গালি আমি কার কাছ থেকে শিখলাম। ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কথাবার্তা। মিলি আপা বললেন, তোমার রাগ হয়েছে- তুমি 'ভাঙ্গা ফুলদানী' বলে গালি দিতে। তুলি আপা বললেন, এই বাজে বকা না দিয়ে তুমি 'ভাঙ্গা কলস' বলে গালি দিতে। তারা দুই বো মিলে আমাকে অনেক বুঝালেন এবং আমাকে ওয়াদা করালেন এরকম কুৎসিত গালি যেন আমি বাকি জীবনে আর না দেই।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ২:৩৫