বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বাজারে গিয়েছি।
এখন মাসে বেশ কয়েকবার বাজারে যেতে হয়। আর্থিক সমস্যার কারনে সারা মাসের বাজার একেবারে করতে পারি না। খুব হিসাব করে বাজার করতে হচ্ছে। প্রতিটা জিনিস খুব দরদাম করে কিনতে হচ্ছে। কারন টাকা সীমিত। এত দরদাম করে জিনিসপত্র কিনতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু কোনো উপায় নেই। আগে প্রচুর বাজার করতাম দরদাম ছাড়াই।
যাই হোক, এমন সময় আমার মোবাইলে ফোন আসে। ফোন করেছে আমার বন্ধু তুহিন। সে বলল, বন্ধু কোনো কথার কাম নাই। তুমি একটা ব্যাগে শার্ট প্যান্ট ভরে আরামবাগ বাস কাউন্টারে চলে এসো। ঢাকার বাইরে যাবো। এতটুকু বলেই তুহিন ফোন রেখে দিলো। কই যাবে? কেন যাবে? কত দিনের জন্য যাবে কিচ্ছু বলল না। অবশ্য তুহিনের অভ্যাস এরকমই।
এদিকে আমার আর্থিক অবস্থা ভীষন খারাপ। কেউ বললেই তো আর চলে যাওয়া যায় না। আমার মনে আছে, বহু বছর আগে একবার টেকনাফ গিয়েছিলাম বন্ধু তুহিনের সাথে। সেই টেকনাফ থেকে পায়ে হেঁটে কক্সবাজার আসতে হয়েছিলো তুহিনের কারনে। তিন দিন সময় লেগেছিলো কক্সবাজার আসতে। এই তিন দিন আমরা থেকে ছিলাম স্কুল ঘরে, মসজিদে অথবা কোনো খালি জায়গায় তাঁবু টাঙ্গিয়ে। তুহিন এরকম কাজ বহুবার করেছে আমার সাথে। অবশ্য তখন অল্প বয়স ছিলো যা খুশি তাই করতে পারতাম। কিন্তু এখন তো তা পারি না। ঘর সংসার আছে। বৌ, বাচ্চা আছে। অনেক হিসাব করে চলতে হয়।
বেশ কিছু দিন ধরে মন ভালো নেই।
নানান রকম চিন্তায় অস্থির সময় যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছি, পকেটে টাকা থাকলে দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসতাম। অবশ্য গতমাসে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা মনের মতোন হয়নি। তাছাড়া গত দেড় বছরে ভালো কোনো ছবি তুলতে পারি নি। আমার এসএলআর ক্যামেরাটা জং ধরে যাচ্ছে দিনকে দিন। ভালো কিছু ছবি তুলতে পারলে মনের অস্থিরতা কিছুটা কমতো, হয়তো। ছবি না তুলতে-তুলতে ছবি তোলার নিয়ম কানুন ভুলে যাচ্ছি।
বাজার থেকে বাসায় এসে সুরভিকে বললাম, ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। সুরভি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো আমার কথা শুনে। বলল, মানে! কোথায়? আমি বললাম, জানি না। ক'দিনের জন্য? বললাম, সেটাও জানি না। সুরভি খুব বেশি রেগে গেল! কিন্তু আসলেই তো আমি কিছু জানি না। তুহিন আমাকে সেসব কিছুই বলে নি।
যাই হোক, ছোট একটা ব্যাগে জামা কাপড় নিয়ে রওনা দিলাম। সুরভি বলল, ভাত খেয়ে যাও। টেংরা মাছ, ফুলকপি-শিম-টমেটো আর আলু দিয়ে রান্না করেছি। আমি বললাম, খেতে ইচ্ছা করছে না। সুরভি বলল, কার সাথে যাচ্ছো? বললাম, তুহিনের সাথে। বন্ধু তুহিন থাকে রাজশাহী। সেখানেই সে ব্যবসা করে। বিয়ে করেনি। করবেও না। তুহিনের সখ হলো ঘুরে বেড়ানো। আমার ছোট ভাই এর কাছ থেকে চার হাজার টাকা ধার নিলাম। খালি হাতে তো আর যেতে পারি না। তিন হাজার টাকা আমার কাছে ছিলো। বাজার করে শেষ করে ফেলেছি সব। তাও অনেক কিছু কেনা হয়নি।
আরামবাগ গিয়ে জানলাম।
আমরা বান্দরবান যাচ্ছি। দু'দিনের জন্য। একটা গ্রুপ বান্দরবান যাচ্ছে। সেই গ্রুপের সাথে তুহিন যাচ্ছে। তুহিনর সাথে আমি যাচ্ছি। রাত দশ টায় বাস ছাড়বে। রাতে দুই বন্ধু হোটেলে খেলাম। ঝামেলা বিহীন খাবার। কাচি। সাথে কোক। বাস দশটায় ছাড়ার কথা থাকলেও বাস ছাড়লো রাত ১২ টায়। যাত্রীরা রেগে মেগে গেছে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছে। আমি চুপ, তুহিনও চুপ। বাস কাউন্টার থেকে বলল, দশটার সময় বাস ছাড়লে ভোর ৬/৭ টায় বান্দরবান থাকতেন। বাস ১২ টায় ছাড়লেও ভোর ৬/৭ টায় বান্দরবান থাকবেন। কোনো চিন্তা নাই। রাত বারোটায় ড্রাইভার গাড়ির সিটে বসে ঘোষনা দিলো, এমনভাবে গাড়ি চালাবো- চাকা মাটিতে থাকবে না। আপনার ধইরা বসেন।
ড্রাইভারের বয়স বেশি না। সে সারারাত সেই রকম বাস চালালো। তুফানের মতো বাস চালালো। ড্রাইভার সত্যি সত্যি ভোর সাড়ে ছয় বান্দরবান পৌছালো। তবে সাধারণ বাস কুমিল্লা গিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে ২০/২৫ মিনিট ব্রেক দেয়। আমাদের ড্রাইভার তা দেয়নি। ভোরে আমরা 'হোটেল হিল ভিউ' থেকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সেখানেই সকালের নাস্তা করলাম। আমরা মোট ২৯ জন। ২৯জনের মধ্যে ৭ জন মেয়ে। ভোরে তিনটা চান্দের গাড়িতে করে আমরা রওনা দিলাম রোয়াংছড়ি। মাঝপথে রোয়াংছড়ি থানা থেকে অনুমতি নিতে হলো। এবং ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিতে হলো প্রত্যেককে। বোয়াংছড়িতে গ্রামীন ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। এদিকে সুরভি একটু পরপর ফোন দিচ্ছে। আমি বাইরে কোথাও গেলে সুরভি ক্লান্তহীণ ভাবে ফোন দিতেই থাকে।
আমরা যাবো দেবতাখুম নামক জায়গায়।
যাওয়ার আগে বিডিআর এর সাথে আমাদের পুরো দলের দেখা করতে হলো। তাদেরও ভোটার আইডি কার্ডের ফোটোকপি দিতে হলো। এবং তারা বলল, ''সুন্দর ভাবে যাবেন, সুন্দর ভাবে আসবেন। স্থানীয় লোকদের সাথে সুন্দর আচরন করবেন। অতি দুর্গম এলাকা খুব বেশি সাবধান থাকবেন''। ইত্যাদি নানান রকম কথা বার্তা। দুপুরে খেয়েছি কচ্ছপতলী বাজারে। রান্না একটূও ভালো না।
আমরা দেবতাখুম এর উদেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। কমপক্ষে দেড় থেকে দুই ঘন্টা হাঁটতে হলো আমাদের। আমাদের গাইড ছিলো দুইজন। এখানে গাইড ছাড়া যাওয়ার অনুমতি নেই। গাইড আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথ খুব বেশি ভয়াবহ। এই কাদামাটির রাস্তা, এই শুকনো রাস্তা, এই জঙ্গল, এই সমতল, এই এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, আবার কখনও হাটু পর্যন্ত পানি মাড়িয়ে যাওয়া, আবার পাহাড় এর পাশ দিয়ে একটু খানি জায়গা তাও পিচ্চিল, শ্যাওলা হাঁটা যায় না- এমন অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে আমি, আমরা ক্লান্ত। মোট তিনবার নৌকায় উঠতে হয়েছে। যদিও বর্ষাকাল না এখন। তবু কিছু কিছু জাগায় পানির পরিমান অনেক বেশি। দেবতাখুম যাওয়া চারটেখানি কথা নয়। একটু ভুল হলে যে কোনো সময় মৃত্যুও হয়ে যেতে পারে। অনেক পরিশ্রম করার পর দেবতাখুম এর দৃশ্য দেখে আমি মুগ্ধ! আমরা মুগ্ধ! চারপাশ দেখে আমার হাঁটার ক্লান্তি নাই হয়ে গেল। মনটা অন্যরকম আনন্দে ভরে গেলো। এত সুন্দর! এত সুন্দর!! এই করোনার মধ্যেও বহু মানুষ দেবতাখুমে। কারো মুখে মাস্ক নেই। সাধারণ টুরিস্টরা বান্দরবান এলে নীলগিরি, মেঘালয়, বগালেক আর শৈল প্রপাত দেখে। দেবতাখুমে অনেক হাঁটতে হয় এবং খুব দুর্গম এলাকা বলে সেখানে সবাই যেতে পারে না।
এদিকে আমার বন্ধু শুরু করলো সাঁতার।
সে নৌকায় উঠবে না। নৌকার পথ সে সাঁতার কেটে যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষন পানিতে থাকার কারনে বন্ধুর হাত পা সব সাদা হয়ে গেছে। আমি এসএলআর ক্যামেরা নিয়ে গেলেও, ছবি তুলেছি মোবাইল দিয়ে। এই ছবিও আমি তুলতাম না, আপনাদের কথা ভেবেই ছবি গুলো তলেছি। দেবতাখুম গিয়ে আমার দুইজন পরিচিত লোকদের সাথে দেখা হয়েছে।
যাই হোক, পুরো ভ্রমনে একেক জনের কমপক্ষে ৪/৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। অথচ আমার বন্ধু আমাকে কোন টাকা খরচ করতে দিচ্ছে না। বন্ধু তুহিন জানে না আমার চাকরি নেই। সে জানে আমি ভালো চাকরি করছি। বেশ ভালো আছি। আমার যেন টাকা দিয়ে সিগারেট পর্যন্ত কিনতে না হয় তার জন্য বন্ধু ঢাকা থেকেই তিন প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে গেছে।
আমি ৫ হাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মাত্র এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে। অবশ্য এই টাকা আমি নিজ থেকেই খরচ করেছি। অপ্রয়োজনীয় এবং ফালতু খরচ। কৃপণতা করলে আত্মা কষ্ট পায়। আত্মকে কষ্ট দেওয়া ঠিক না। পরের দিন রাতে ঢাকার উদেশ্যে বাসে উঠলাম। শরীর বেশ ক্লান্ত। চোখ ভরা ঘুম। বাসে উঠার আগে ইচ্ছে মতো খেয়ে নিলাম।
এই ড্রাইভার গাড়ি ভালো চালাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ড্রাইভার একটা একসিডেন্ট করবে। আমি ড্রাইভারের দিকে লক্ষ্য রাখছি। তুহিন গভীর ঘুমে। খুব ভোরে বাসায় এলাম। তুহিনকে জোর করে বাসায় নিয়ে এলাম। দুপুরে সুরভি বেশ ভালো খাবারের আয়োজন করলো। তুহিন বলল, ভাবী আপনার হাতের রান্না খেতেই আজ এসেছি। সুরভির হাতের রান্না যারা খেয়েছে, সবাই মুগ্ধ হয়েছে।
এক নজরে রোয়াংছড়ি, বান্দরবানঃ
১। ১৯৭৬ সালে রোয়াংছড়ি থানা গঠিত হয়।
২। রোয়াংছড়ি উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৫৩ হাজার।
৩। এখানে কোনো প্রকার মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই।
৪। দেবতাখুমের প্রধান বৈশিষ্টই হচ্ছে তার বুক চিড়ে ভেলার চলাচল।
৫। রোয়াংছড়ি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সাঙ্গু নদী।
৬। রোয়াংছড়িতে দর্শনীয় স্থান তিনটি- তিনাপ সাইতার, দেবতাখুম এবং রোয়াংছড়ি বৌদ্ধ বিহার।
৭। পথে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি আদিবাসীদের ছোট ছোট কয়েকটি গ্রাম।
৮। বান্দরবানের অধিকাংশ সীমান্তে বিজিবির সীমান্তচৌকি ও ক্যাম্প নেই।
৯। সাঁতার জানা না থাকলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক।
১০। এখানে বেশ কয়েকটি প্রাইমারী স্কুল রয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১২:২০