গত বছর কলকাতা গিয়েছিলাম।
কলকাতা যাওয়ার আগে আব্বার সাথে দুই ঘন্টা বসে গল্প করলাম। তখন বুঝতে পারি নি এটাই আব্বার সাথে আমার শেষ গল্প করা। আব্বা বলল, কলকাতা বৈঠক খানা রোডে তোমার দাদার বাড়িটা দেখে এসো। কলকাতা থেকে আব্বার জন্য দুটা শার্ট কিনেছিলাম। সেই শার্ট আব্বাকে আর দেওয়া হয়নি। আলমারিতে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে শার্ট দুটা বের করে হয়তো দেখবো।
আজ সকালে ঘুমে ছিলাম।
সুরভি ডেকে বলল, তোমার ফোন এসেছে। ফোন ধরতেই জানতে পারলাম আব্বা মারা গেছে। মাথার ভেতর ভন ভন করে উঠলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। খুব কান্না আসছিলো। কিন্তু আমি কাঁদি নি। আব্বা বারডেম হাসপাতালে ভরতি ছিলো। করোনা ধরা পড়লো। আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর ধীরে ধীরে সেরে উঠলো। ডাক্তার বলল, শনিবার বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু আজ সকালে হঠাত মারা গেলো।
জুম্মার নামাজ শেষে জানাজা হলো।
তারপর নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের বাড়ি। স্কুলে মাঠে আবার জানাজা হলো। আছরের নামাজ শেষে দাদা দাদীর করবের পাশে কবর দেওয়া হলো। আমি মনে মনে চাচ্ছিলাম আব্বার কবর ঢাকাতেই হোক। আমাদের বাসার কাছেই কবরস্থান আছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী যে যেখানে ছিলো সবাইই এসেছে। যারা আসতে পারেনি তারা ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছেন। সমবেদনা জানিয়েছেন।
আব্বাকে যখন কবরে নামানো হচ্ছিলো-
আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো। বুকের ভেতরে যেন কেমন করছিলো। বারবার চোখ ভিজে আসছিলো। দুনিয়ায়তে এই একজন মানুষের উপরেই আমার আস্থা, ভরসা ছিলো। একজন সন্তানের জন্য বাপ অনেক বড় ব্যাপার। আমার মাথার উপর থেকে বট গাছ নাই হয়ে গেলো। ভীষন একা হয়ে গেলাম। এখন কেউ বলবে না, ভয় নেই। আমি আছি। আমার মন খারাপ দেখলেই, আব্বা বলতো- তোমার কোনো সমস্যা নেই। তোমার বাপ বেঁচে আছে। কাজেই কোনো চিন্তা নেই।
কাফনের কাপড় সরিয়ে শেষ বারের মতো আব্বার মুখটা দেখলাম।
মনে হলো আব্বা আরামে ঘুমাচ্ছে। মুখে কোনো কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব। কোনো টেনশন নেই। সহজ সরল একটি মুখ মনে হলো। দেখে মনে হলো না- তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলো। আমার ইচ্ছা করলো আব্বাকে জড়িয়ে ধরে রাখি বুকের মধ্যে। একজন গ্রেট মানুষ ছিলেন। কোনো হিংসা ছিলো না, লোভ ছিলো না। সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলতো। সবাই আব্বাকে খুব পছন্দ করতো। আব্বার বিরুদ্ধে কারো কোনো নালিশ ছিলো না।
আব্বার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে আজ।
কত শত শত সৃতি, কত ঘটনা, কত গল্প! একদিন রাস্তায় আব্বার সাথে দেখা, আব্বা আমাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলো। আমি তো লজ্জায় শেষ! এত বড় ছেলেকে কেউ হাত ধরে রাস্তা পার করে দেয়? আরেকদিন জোর করে ধরে সেলুনে নিয়ে গেলো। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চুল কাটিয়ে দিলো। একদিন আমাদের বাসায় একটা চোর ধরা পড়লো। সেই চোরকে আব্বা একটা থাপ্পড়ও দেয় নি। বরং তাকে বসিয়ে পেট ভরে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। দুটা শার্ট, লুঙ্গি দিয়েছে এবং পকেটে কিছু টাকাও গুজে দিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৫০