প্রিয় কন্যা আমার।
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ইং, রোজ বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় তোমার জন্ম। নিজের সন্তানের চেয়ে প্রিয় দুনিয়াতে আর কিছু হয় না। ৩০ তারিখ রাতে তোমার মায়ের ব্যথা শুরু হলো। তখন আমি বই পড়ছিলাম। বইয়ের নাম- 'হাত বাড়িয়ে দাও'। ছোট বই। বইটা আগেও বেশ কয়েকবার পড়েছি। রাত তখন দুইটা। তোমার মা বলল, খুব বেশী ব্যথা করছে। আমি বললাম, ঘুমাতে চেষ্টা করো। ব্যথা কমে যাবে। সম্ভবত গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। তোমার মা বলল, এই ব্যথা গ্যাস্ট্রিকের না। আমি দোতলায় ফোন দিয়ে ভাবীকে ডেকে আনলাম। ভাবী সাথে সাথে চলে এলেন এবং বললেন, হ্যা এটা সেই ব্যথা। বাচ্চা হবে।
সকাল পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। ভাবী থাকলেন তোমার মায়ের সাথে। বাসার কাছেই একটা হাসপাতালে গেলাম সকাল আট টায়। মুহুর্তের মধ্যে আয়া, নার্স, ডাক্তার সব ছুটে এলেন। তোমার মাকে নিয়ে যাওয়া হলো ওপারেশন থিয়েটারে। আমি অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করতে থাকলাম। পকেট থেকে মোবাইল বের করার সময় মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেলো। বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো মোবাইলটা। অথচ এই মোবাইলটা দুই বছর ধরে ব্যবহার করছি। কিন্তু কখনও হাত থেকে পড়েনি।
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি।
কিছুক্ষন পর একজন নার্স এসে বললেন, আপনার কন্যা হয়েছে। মা এবং কন্যা দুজনেই ভালো আছে। সুস্থ আছে। নরমাল ডেলিভারী। আমি জানতাম আমার কন্যা হবে। মনে মনে আমি কন্যা সন্তানের আশাই করেছিলাম। কেউ যখন জিজ্ঞেস করতো- তুমি কি চাও? আমি সাথে সাথে স্পষ্ট করে বলতাম আমি একটা কন্যা চাই। পরীর মতোন। আমার মনের আশা পূরন হয়েছে। যাই হোক, কিছুক্ষন পর একজন নার্স তোমাকে কোলে করে আমার কাছে নিয়ে এলো। আমি তোমাকে দেখে ভীষন অবাক! তুমি অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে একটু তাকালে। ছোটবেলা আমি দেখতে এরকমই ছিলাম।
নার্স বললেন, কোলে নিন।
আমি বললাম, এখন কোলে নিবো না। আগে হাত মূখ ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। চারিদিকে করোনা। খুব সাবধান থাকা দরকার। আমি নার্সকে বললাম, আপনাদের সবাইকে আমি খুশি করে দেবো। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার সময় প্রতিটা নার্স, আয়াকে আমি বখশিস দিয়েছি। তারা যতটা আশা করেছিলো- তার চেয়ে তিন গুন বেশী দিয়েছি। হাসপাতালের কাছেই ছিলো আমার বড় ফুপুর বাসা। বড় ফুপু সকাল এবং দুপুরে হাসপাতালে খাবার পাঠিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে তোমাকে বাসায় নিয়ে এলাম। আমি ভীষন আনন্দিত। সুরভিও ভীষন আনন্দিত। একটু পর পর আনন্দে সুরভির চোখ ভিজে উঠছে। তোমার নাম দুইজন ঠিক করেছেন অনেক গবেষনা করে। আমার বড় ভাই তোমার নাম রেখেছেন, 'ফারাজা তাবাসসুম খান (ফাইহা)। এবং তোমার বড় মামা তোমার নাম রেখেছেন- 'হানিত্রা নূর। নাম নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। তোমার মা যে টা ভালো বুঝবে সেটাই রাখবে। কারন দীর্ঘ ৯ মাস তোমার মা অনেক কষ্ট করেছে। তার অধিকারই বেশী।
তোমাকে যতই দেখি, ততই ভালো লাগে।
তোমাকে হাসপাতাল থেকেই বাসায় আনতেই- অসংখ্য মানুষ বাসায় ভিড় করে ফেললো। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন। পরিচিত-অপরিচিত সবাই। সবাই তোমাকে দেখতে আসছে। সবাই তোমাকে আদর করতে চায়। কোলে নিতে চায়। ছবি তুলতে চায়। যদি তুমি ঘুমে থাকো, তখন তারা অপেক্ষা করে। ঘুম ভাঙ্গলে তারা তোমাকে কোলে নেবে এবং ছবি তুলবে। এদের অত্যাচারে তুমি অতিষ্ঠ, আমরাও অতিষ্ঠ। অথচ ওদের বের করে দিতে পারছি না। তাদের বের করেই দেওয়া উচিত। কারন চারিদিকে করোনা। অথচ তারা কেউই কোনো নিয়ম কানুন মানছে না। রাগে আমার গা জ্বলছে।
যাই হোক, তোমার জন্মের আগেই তোমার নানা, মামা-মামী এবং তোমার বড় মা (আমার ভাবী) প্রচুর জামা কাপড়, কাঁথা, ডায়পার, দুধের বোতল, চুসনী ইত্যাদি যা যা লাগে সব আগে থেকেই কিনে রেখেছেন। এবং প্রচুর পরিমানে কিনে রেখেছেন। মনে হয় আগামী এক বছর তোমার জন্য আর কিচ্ছু কিনতে হবে না। তবে আমি বাইরে গেলেই তোমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসি। আজ আনলাম একটা মশারী। যদি অলরেডি তোমার একটা মশারী আছে। বাসায় প্রতিদিন মানুষ আসা অব্যহত আছেই। অবশ্য তারা তোমার জন্য নানান রকম জিনিস পত্র এনেছে। কেউ সোনার আংটি, কেউ গলার চেইন, কেউ নাকের দুল।
তোমার বড় বোন পরী।
সে তোমাকে ভীষন ভালোবাসে। পরী চায় সারাক্ষণ তোমাকে কোলে করে রাখতে। কোলে না দিলে সে রাগ করে। আমি পরীকে বলেছি- তোমার জন্য কখনও শিক্ষক রাখবো না। তোমাকে লেখাপড়া করাবে পরী। পরী লেখাপড়ায় খুবই ভালো। লেখাপড়ার ব্যাপারে সে খুব সিরিয়াস। যাই হোক, সারারাত আমি আর তোমার মা তোমার পাশে জেগে বসে থাকি। তোমার ডায়পার বদলে দেই। তুমি কান্না করার আগেই তোমার মা তোমাকে দুধ খাওয়ায়। তুমি কান্না করলে আমার ভীষন কষ্ট হয়। তোমার কান্না একদম আমার বুকে এসে তীরের মতোন লাগে। আবার তুমি একটূ হাসলে মনটা খুশীতে ভরে যায়।
সারা পৃথিবী একদিকে আর তুমি অন্য দিকে।
তোমার জন্মের দুই দিন পর তোমার চোখ বেশ খানিকটা হলুদ হয়ে গেলো। অর্থ্যাত তোমার জন্ডিস হয়েছে। তোমাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। ডাক্তার তোমার রক্ত পরীক্ষা করলেন। আমি হাসপাতালে যাই নি। কারন সুই দিয়ে তোমার এতটুকু শরীর থেকে রক্ত নিবে- এটা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেলো- তোমার জন্ডিস। দুই দিন পর আবার রক্ত পরীক্ষা করা হলো- তখন জানা গেলো জন্ডিস এর পরিমান কিছুটা কমেছে। ডাক্তার বললেন তোমাকে দুইবেলা রোদে রাখতে। তোমাকে রোদে নিয়ে বসে থাকতে আমার ভীষন ভালো লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৪৮