মানুষের যখন বয়স বাড়ে, তখন ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।
ছোটবেলার বহু ঘটনা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু ইদানিং হুটহাট বহু ঘটনা চোখের সামনে ভেসে আসে। আমাদের পাশের বাসায় কাদের নামে একজন লোক থাকতেন। আমরা সবাই তাকে কাদের মামা বলে ডাকতাম। তিনি ছোটদের খুবই ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে মামা আমাদের সাথে ফুটবল খেলতেন।
একবার কাদের মামার সাথে তার গ্রামের বাড়ি গেলাম। বাড়ি ঢাকার কাছেই সোনারগাও। যদিও এখন সোনারগাও যেতে এক ঘন্টা সময় লাগে। কিন্তু তখন অনেক সময় লাগতো। কাদের মামার বাসায় গিয়ে দেখি তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা উঠানে বসে ভাত খাচ্ছে ঢেঁড়স ভর্তা দিয়ে। আর কোনো কিছু নেই। আমাকেও ঢেঁড়স ভর্তা দেওয়া হলো। ঢেঁড়স বাজি বা ভর্তা আমি কোনোটাই খাই না। লাল চালের ভাত। সেই ভাত আবার কেমন নরম হয়েছে। এরকম খাবার আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। সামান্য ডাল বা অন্য কোনো তরকারীও নেই। কাদের মামা যে এতটা দরিদ্র সেটা আমি জানতাম না।
তখন আমি ক্লাশ সেভেন এ পড়ি।
একলোক আমেরিকা থেকে আমাদের বাসায় কিছুদিন থাকতে এসেছেন। তবে তিনি নিজে রান্না করে খাবেন। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকেন। সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় আসেন। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- সারাদিন কোথায় থাকেন? তিনি বললেন, আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের খুঁজি। তাঁরা হারিয়ে গেছে। বিশ বছর ধরে তাদের কোনো খোজ আমি জানি না। যাই হোক, তাকে দেখলাম পলিথিন ব্যাগে করে কিছু ঢেঁড়স নিয়ে এসেছেন। আমার সামনেই ঢেঁড়স সিদ্ধ দিলেন। কিছু পরিমান লবন ছিটিয়ে দিলাম। তারপর কচকচ করে খেতে শুরু করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। এটাও সম্ভব! আমি বললাম, এই বস্ত খেতে আপনার কাছে কেমন লাগছে। তিনি বললেন, তুমি খেয়ে দেখো। খেতে অসাধারণ হয়েছে। জন্মভূমির সব সবজি আমার প্রিয়। কতদিন পড়ে খাচ্ছি!
ঢেঁড়স আমি পছন্দ করি না।
তবে দুই একবার খেয়েছি। খেতাম না। সুরভি খুব জোর করাতে সামান্য খেয়েছি। সুরভি ঢেঁড়স ভাজি করে। আবার মাঝে মাঝে চিংড়ি মাছ দিয়েও রান্না করে। বাসার সবাই বলে সুরভির ঢেঁড়স ভাজি বা ঢেঁড়স এর তরকারী খেতে খুব ভালো হয়। আমি বাসার জন্য সবজি কেনার সময় ঢেঁড়স কিনি। সব সময় এক কেজি ঢেঁড়স কিনি। দাম সস্তা। ৪০/৫০ টাকা কেজি। পরী বেশ মজা করে ঢেঁড়স খায়। সেদিন দেখলাম, পরী খেতে বসেছে। সে ঢেঁড়স দিয়েই সব ভাত খেয়ে নিলো। অথচ টেবিলে দেশী মূরগী ছিলো। ডাল ছিলো। লাল শাক ছিলো। আমি চুপ করে পরীর খাওয়া দেখলাম। খাওয়া শেষে জিজ্ঞেস করলাম, শুধু ঢেঁড়স খেলে কেন? মূরগী বা ডাল নিলে না কেন? পরী বলল, ঢেঁড়স ভাজিটা খুব মজা হয়েছে। কিভাবে রান্না করে কে জানে! খেতে দারুন হয়। পরীর দেখাদেখি আমিও ভাতের সাথে ঢেঁড়স নিলাম। কিন্তু আমি ঢেঁড়স খেয়ে মজা পেলাম না। আজিব!
একবার সিলেট বেড়াতে গিয়েছিলাম।
সেবার সিলেট গিয়ে অনেকদিন ছিলাম। পুরো সিলেটের আনাচে কানাচে সব ঘুরে দেখেছি। যাই হোক, যে বাসায় বেড়াতে গিয়েছি তাঁরা অনেক ধনী। সারাদিন ঘুরে বেড়াই তাদের গাড়িতে করে।। রাতে তাদের বাসায় খাই। খেতে বসে অবাক হতে হয়। টেবিল ভর্তি নানান রকম খাবার। কমপক্ষে ১৫/২০ পদ তো হবেই। যত পদই থাকুক আমি সাধারনত গরুর মাংস আর ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য কিছু খাই না। যাই হোক, গরুর মাংস দিয়ে মজা করে গরম ভাত খাচ্ছি। পোলাউ ছিলো নিই নি। পোলাউ এর চেয়ে সাদা ভাত'ই আমার বেশি ভালো লাগে। তখন বাড়ির কর্তী বললেন, এই ছেলে তুমি এক পদ দিয়ে খাচ্ছো কেন? রান্না কি ভালো হয়নি? বলেই তিনি আমার প্লেটে একগাদা ঢেঁড়স দিয়ে দিলেন। ঢেঁড়স রান্না হয়েছে ঘন ডাল দিয়ে। আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলাম। আমি আরাম করে খাচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলা আমার খাওয়াটা নষ্ট করে দিলেন।
এই কিছুদিন আগের কথা।
দুপুরে এক হোটেলে খেতে গিয়েছি। রুই মাছ আর ডালের অর্ডার করেছি। ওয়েটার এসে আমার প্লেটে ঢেঁড়স দিয়ে দিলো। আমি বললাম, এটা কি করলে? ওয়েটার বলল, ঢেঁড়স ভাজি দিলাম স্যার। এটা ফ্রি। দাম দিতে হবে না। আমার খুব রাগ হলো। আমি বললাম, আমি আজীবন 'ফ্রি' ব্যাপারটা অপছন্দ করেছি। আর তুমি আমাকে আমার অনুমতি না নিয়েই ফ্রি দিয়ে দিলে! ওয়েটার বলল, ঢেঁড়স সবাই খায়। এমন কি অনেকে একবার দিলে আরেকবার চেয়ে নেয়। আমি বললাম, ঢেঁড়স আমি খাই না। একেবারেই খাই না। বলা যায় আমি ঢেঁড়স অপছন্দ করি। আর তুমি সরাসরি একগাদা ঢেঁড়স আমার প্লেটে ঢেলে দিলে! এই ভাত ফেরত নিয়ে যাও। আবার নতুন করে ভাত আনো। ওয়েটার বেশ বিরক্ত হলো আমার উপর। যতই বিরক্ত হোক, খাওয়া শেষে বেশি করে বকশিস দিয়ে তাকে খুশি করে দিবো। মানুষকে খুশি করতে আমার ভালো লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৪১