রাত দুই টা। ভয়াবহ এক শীতের রাত।
আখাউড়া রেল স্টেশন। আমি যাবো ঢাকা। সকালে আমার এক জরুরী কাজ আছে। এখন ঢাকা যাওয়ার যে ট্রেন পাবো সেটাতেই উঠে পড়বো। সাধারনত রাতের বেলা 'মোহনগর গোধুলি' এবং 'উপকুল এক্সপ্রেস' পাওয়া যায়। মোহন নগর ট্রেন রাত বারটায় আসার কথা ছিলো। এখন বাজে রাত দুইটা অথচ ট্রেনের কোনো খবর নাই। স্টেশন মাস্টারের ঘর তালা দেওয়া। ষ্টেশনে কিছু চায়ের দোকান সারারাত খোলা থাকে। তাদের জিজ্ঞেস করলাম। তারাও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলো না। একজন শুধু বলল, বাংলাদেশের ট্রেনের সময়ের উপর কোনো আস্থা রাখবেন না। পারলে বাসে চড়বেন। ট্রেনে নয়। বাস সময় মতো ছাড়ে। ট্রেন নয়।
আমি রীতিমতো শীতে কাঁপছি।
চারিদিকে গাঢ় কুয়াশা। কিছুই দেখা যায় না। যদিও আশে পাশে বেশ কয়েকটা সরকারি লাইট মিটমিট করে জ্বলছে। আমি একটা ভারী কোট পড়েছি। গলায় উলের মাফলার প্যাচিয়েছি। তবু শীত তীরের মতো এসে গায়ে লাগছে। ঠান্ডায় মুখ দিয়ে সিগারেটের মতো ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি সাধারনত স্টেশনের ওয়েটিং রুমে যাই না। খুবই নোংরা অবস্থা থাকে। বাথরুমের অবস্থা তো জঘন্য। কিন্তু শীত থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে ওয়েটিং রুমে গেলাম। ছাগল, হাঁস মূরগীসহ পুরো ঘর জুড়ে নানান শ্রেনীর মানুষ শুয়ে আছে। পা রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অনেক মানুষ এই শীতের মধ্যে শুয়ে আছে। কেউ কেউ ছালা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
একটা চায়ের দোকানে বসে আছি।
চায়ের দোকানদার কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। ডাকলে হয়তো চা বানিয়ে দিবেন। স্টেশনের চা আমার মুখে দিতে ইচ্ছা করে না। খুব বাজে হয়। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম। এমন সময় একটা মেয়ে আমার পাশে এসে বসলো। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। দেখতে স্বস্তিকা মুখার্জির মতোণ। অফ হোয়াইট শাড়ি পড়া। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল। দুই হাত ভরতি কাঁচের চুড়ি। চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে। শাড়ির আঁচল অনেকখানি লম্বা। খুব সুন্দর মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে আমি মুগ্ধ! ভীষন মিষ্টি চেহারা। আমার পাশে বসে আছে অথচ তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। বাতাসে মেয়েটার চুল মুখের উপর এসে পড়ছে। আমি চারিদিকে বেলি ফুলের সুবাস পেলাম! বেলি আমার প্রিয় ফুল।
মেয়েটা বলল, আপনি কি চা খেতে চান?
আমি মাথা উঁচু-নিচু করলাম। মেয়েটার কন্ঠ খুব মিষ্টি। মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে ফ্লাক্স বের করলো। দুটা ওয়ানটাইম কাপ বের করে আমাকে চা দিলো। আমি চায়ে চুমুক দিলাম। দারুন চা হয়েছে। চিনি পারফেক্ট। বেশির ভাগ মানুষ চায়ে চিনি দিতে গিয়ে হয়- বেশি দেয় না হয় কম দেয়। এই মেয়ের চা'তে চিনি একদম ঠিক আছে। মেয়েটা বলল, চা কেমন হয়েছে? আমি বললাম, জীবনানন্দের কবিতার মতোন সুন্দর হয়েছে। মেয়েটা বলল কোন কবিতা? আমি আবৃত্তি করলাম- এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;/ সারারাত দখিনা বাতাসে/ আকাশের চাঁদের আলোয়/ এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি—/ কাহারে সে ডাকে!
মেয়েটা বলল, আপনার কবিতা আবৃত্তি সুন্দর হয়েছে।
আমি বললাম, এই কবিতা জীবন বাবু ১৯৩২ সালে লিখেছিলেন। কবিতাটির মূল সুর আদৌ যে ক্যাম্প বা হরিণ শিকার নয় সেই বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি কবিতার মধ্যভাগে। মেয়েটা বলল, 'ঘাই হরিনী' বিষয়টা কি একটু বুঝিয়ে বলুন তো। আমি বললাম, ঘাই হরিণী বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে জ্যান্ত হরিণ, যাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জীবনের এক অসফল অধ্যায়ের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে অবজ্ঞা ভরে। কী অসাধারণ ভাবে জীবনানন্দ মানুষের অস্তিত্বের সংকট আর কঠিন নিরাশ্রয়তার ভাবনা তুলে ধরেছেন এই কবিতায়! কবিতার শেষে আমাদের অন্তরে রক্তক্ষরণ হয়।
মেয়েটা বলল, আপনি কি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র নাকি?
আমি মনে মনে ভাবছি আজ ট্রেন না আসুক। এই মেয়েটার সান্নিধ্য আমার ভালো লাগছে। একটু পরপর মেয়েটার কাছ থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রান এসে লাগছে। মেয়েটার মধ্যে কোনো জড়টা নেই। কি সহজ সরল সুন্দর ভাবে বসে আছে আমার পাশে। গল্প করছে। সারা জীবন এরকম সিনেমায় দেখেছি। গল্প উপন্যাসে পড়েছি। মেয়েটা বলল, কি ভাবছেন? আমি বললাম, আরেক কাপ কি চা কি পেতে পারি? মেয়েটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল, অবশ্যই। এমন সময় চায়ের দোকান বলল, আপনি একাএকা কার সাথে কথা বলছেন? আমি বললাম, মানে? পাশে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা নেই। কেউ কোথাও নেই। অথচ আমার সামনে ওয়ানটাইম কাপে এক কাপ চা। চা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১:৫০