বহু বছর আগের ঘটনা।
এলজিইডি'র ডাক বাংলোয় উঠেছিলাম। শীতকাল ছিলো। খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কাউকে কিছু না জানিয়ে একা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যাই। একদম ইন্ডিয়ার বর্ডারের কাছে একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। অতি দরিদ্র গ্রাম। গ্রামের অনেকখানি ঘুরে বেড়ালাম। একটাও পাকা বাড়ি দেখলাম। এমিন কি পাকা মসজিদ বা মন্দিরও দেখলাম না। মাটির রাস্তা। রাস্তা ভেজা ভেজা কুয়াশার কারণে। সকাল সাত টা বাজে। এক কাপ চা খাবো কোনো দোকান চোখে পড়লো না। শীতের সকালে এক কাপ চা খেতে না পারলে ভালো লাগে! শহরে তো মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান।
একটা বাড়ির সামনে দাড়ালাম।
আসলে বাড়ি বলা ঠিক না। মাটির ঘর। উপরে ছন। মাটি ফেটে গেছে নানান জায়গা দিয়ে। একদম হত দরিদ্র অবস্থা। আমাদের দেশের মানুষ গুলো খুব বেশি দরিদ্র। উঠানে তিনটা দশ বারো বছরের ছেলে মেয়ে। তাদের পোষাকের অবস্থা শোচনীয়। পায়ে জুতো নেই। কিন্তু তিনজনের মুখে হাসি। আমাকে দেখে তিনজনই দৌড়ে এলো। আমি বাচ্চাদের বললাম, ঢাকা থেকে এসেছি। ডাক বাংলোয় উঠেছি। হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের বাড়ির সামনে এলে এসেছি। আমাকে কি এক কাপ আগুন গরম চা খাওয়াতে পারবে? এমন সময় ছেলে মেয়েদের মা ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বলল, আপনি বসুন চা দিচ্ছি।
আমি উঠানে বসলাম।
দুই ছেলে মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করছে। মেয়েটা আমার পাশে বসলো। বাচ্চা মেয়েটার মুখ ভীষন রকমের মিষ্টি। আমি বললাম, তুমি যাও, তোমাকে মাকে সাহায্য করো। মেয়েটা বলল, আমি খুব অসুস্থ। মা আমাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা কোথায়? মেয়েটা বলল, বাবা শহরে গেছে। আজ বিকেলে আসবে। আসার সময় আমাদের জন্য রাতা মোরগ নিয়ে আসবে। আমি বললাম, তোমার বাবা কি কাজ করেন? মেয়েটা বলল জানি না। মনে হয় কুলির কাজ। আমি মেয়েটাকে বললাম, কুলির কাজ কি তুমি জানো? মেয়েটা বলল, কষ্টের কাজ। অনেক কষ্ট। আব্বা বলেছে।
দুই ছেলে মিলে মাটির চুলায় আগুন ধরাচ্ছে।
মা আটা মাখছে। মা ছোট ছেলেকে বলল, ঘরের ভিতর থেকে লবন নিয়ে আসো। ছোট ছেলে এক দৌড় দিয়ে লবন নিয়ে এলো। আধা ঘন্টার মধ্যে আমাকে দুটা লাল আটার রুটি আর লাল চা দেওয়া হলো। ঘরে চিনি ছিলো না। তাই চায়ে এক চিমটি লবন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন ভাইবোন লাল চায়ে লাল আটার রুটি ভিজিয়ে খাচ্ছে। শক্ত রুটি আর চিনি ছাড়া চা নিশ্চয়ই খুব মজার কিছু না। অথচ পরিবারের সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে আমার মায়ের কথা মনে পড়লো। মা খুব সকালে উঠে আমাদের জন্য নাস্তা বানিয়ে রাখতো। নাস্তার সাথে অনেক কিছু থাকতো।
আমি ডাক বাংলোয় ফিরে এলাম।
গোছল করলাম গরম পানি দিয়ে। ডাইনিং এ খেতে গেলাম। দেখি নানা রকম খাবার। রুটি গুলো খুব নরম। ভাজি, ডাল, ডিমসহ আরো অনেক কিছু। পাউরুটি, জেলিও আছে। চা-কফি দুটাই আছে। বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে আসছে। লাল আটার শক্ত রুটি আর চিনি ছাড়া লাল চা। একটা হত দরিদ্র পরিবার। ভাঙ্গা বাড়ি। বাচ্চা গুলোর চোখ মুখ মলিন। পায়ে জুতো নেই। পরিবারের প্রধান ব্যাক্তি শহরে কুলির কাজ করে। আমি ওদের কোনো সাহায্য করি নি। খোজ নিইনি তিন ভাইবোন স্কুলে পড়ে কিনা। দুপুরে আজ ওরা কি খাবে? ঘরে চাল আছে তো? বিকেলে কি বাবা রাতা মোরগ নিয়ে সত্যি সত্যি আসবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২২ রাত ২:৩৩