ছবি তুলেছে- আমার কন্যা পরী।
পরীকে আমি ছবি তোলা শিখাচ্ছি।
প্রথমে শিখালাম কিভাবে ক্যামেরা ধরতে হয়। প্রচুর ভিড়ের মধ্যে কিভাবে ক্যামেরা সাবধানে রাখতে হয়, ব্যবহার করতে হয়। ফ্রেমিং শিখালাম। ছবির ফ্রেমিং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। ছবির সাবজেক্ট কে কতটা গুরুত্ব দিতে হবে। ছবিতে অদরকারী কি কি রাখা যেতে পারে। কি কি একেবারেই রাখা যাবে না। পরীর একটা ভালো দিক হলো- সে সব কিছু অতি দ্রুত বুঝে নিতে পারে। ফারাজার জন্মদিনের ছবি গুলো সব পরী তুলে দিয়েছে। যদিও ছবি গুলো ভালো হয়নি। কিন্তু পরী ভালো ছবি তুলতে পারবে। সেটা আমার কাছে পরিস্কার হয়েছে। পরীর একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে। সেখানে সে নানান রকম ভিডিও তৈরি করে ছাড়ে। নীতু নামের মেয়েটা বলল, আমিও ছবি তোলা শিখতে চাই। আমাকেও শিখাতে হবেই।
আমাদের বাসায় একটা মেয়ে এসেছে।
আমার ভাবীর দূর সম্পর্কের লতায় পাতায় আত্মীয়। সে আমাদের বাসায় থাকবে। এখানেই কোনো কলেজে ভরতি হবে। মেয়েটার নাম নীতু। নীতু এবার এসএসসি পাশ করেছে। খুব শ্রীঘই তাকে কলেজে ভরতি করা হবে। নীতুর খাওয়া দাওয়া, লেখাপড়ার খরচ সব আমরাই দিবো। গ্রামের একটা মেয়ে। ধনী পরিবারের কন্যা নয়। তবে নীতু বাপ মায়ের একমাত্র কন্যা। ছোট একটা মেয়ে আমাদের সাথে থাকবে। আমাদের পরিবারের তাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। বরং সবাই খুশি। নীতুর গ্রামের বাড়ি বরিশাল। বরিশাল নিয়ে নীতুর বেশ অহংকার আছে। তার কথা বার্তা থেকে তা স্পস্ট বুঝা যায়। থাকাটাই স্বাভাবিক। নীতুর কাছ থেকে জেনেছি তাদের গ্রামের চেয়ারম্যান একসময় গরু চুরী করতো। এখনও সবাই তাকে গরু চোর বলে।
নীতু সারাদিন দুটা কাজ করে।
মোবাইল টিপাটিপি আর টিভি দেখা। টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখে, নাটক দেখে। তার প্রিয় বাংলা সিনেমা ''বাসর রাত''। কেউ যদি বলে এক গ্লাস পানি দাও তো নীতু। সে স্পষ্ট বলে- পারব না। সিনেমা দেখছি এখন। ভাবী যদি বলে, ছাদে কাপড় আছে। নীতু নিয়ে আসতো। নীতু বলে, সিড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট লাগে। পারব না। নীতু টেবিলে খেতে বসে। খাওয়ার সময় সে পানি নিয়ে খেতে বসে না। সে আমাকে বলে- আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো। আমি বাইরে যাবার সময় বলে, আসার সময় আমার মোবাইলে ফ্লাক্সি করে দিয়েন। আমার জন্য একটা মেমোরি কার্ড নিয়ে আইসেন। এযুগের ছেলে মেয়েদের মন মানসিকতা আমি বুঝি না। এই প্রজন্ম বড় অদ্ভুত। মনে পড়ে আমিও একসময় ছোট ছিলাম। কত সহজ সরল ছিলাম। লজ্জা ছিলো, ভয় ছিলো।
নীতু প্রতিদিন মুখে এলোভেরা ঘসে।
এলোভেরা ঘসতে ঘসতে সুরভির এলোভেরা গাছ শেষ করে ফেলেছে। প্রতিদিন সে সাজে। ভাবী আর সুরভির মেকাপ বক্স খালি করে ফেলেছে। লিপস্টিক আর নেইল পলিশ দেয় ঘন্টায় ঘন্টায়। প্রতিদিন সে দুপুরে অথবা রাতে বলবে, আজ আমি পিকজা খাবো। 'পিজা' বলতে পারে না। অথবা বলবে, দোসা খাবো। সাথে কোক। এরকম প্রতিদিন তার নানান রকম আবদার মেটাতে হচ্ছে। মানুষ এত আবদার বাপ মায়ের কাছেও করে না। আজ সে ফুচকা খাবে। আমি বললাম, সমস্যা নাই। বাসার কাছেই একলোক ফুচকা বিক্রি করে। সন্ধ্যায় এনে দিব। নীতু বলল, বাসার কাছে ফুচকা মজা না। আমি নিউ মার্কেট গিয়ে ফুচকা খাবো। ড্রাইভারকে বলে রাখেন সে যেন সন্ধ্যায় থাকে। গত একমাসে নীতু ঢাকা শহর প্রায় অর্ধেক ঘুরে ফেলেছে। তাকে অনেক গুলো নতুন জামা কিনে দেওয়া হয়েছে।
নীতু সারারাত জেগে মোবাইল চালায়।
সকাল ১২ টার আগে ঘুম থেকে উঠে না। তখন তাকে নতুন করে পরোটা ভেজে দিতে হয়। নীতু ঠান্ডা পরোটা একদম খেতে পারে না। নীতুকে থাকার জন্য পরীর ঘরটা দেওয়া হয়েছে। এখন সে পরীকে বলে আমার ঘরে খুব প্রয়োজন ছাড়া ঢুকবে না। নীতি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবীকে জিজ্ঞেস করে আজ কোথাও দাওয়াত আছে? সে প্রতিদিন কোনো দাওয়াত অথবা মার্কেটে না গেলে তার ভালো লাগে না। দাওয়াত না থাকলে তাকে বাইরে থেকে খাবার এনে দিতে হয়। মোটামোটি বাসার সবাই নীতুকে আদর করে। কারন দরিদ্র ঘরের একটা মেয়ে। গ্রাম থেকে এসেছে। বাবা মা থাকে গ্রামে। বাসার সবাই বেশ আদর আহ্লাদ করেই কথা বলে। বসার ঘরের টিভি দখল নিয়েছে নীতু। সে তার হাত থেকে রিমোট সরায় না। পরীর সেম্পুরর বোতল তিন মাস লাগে শেষ করতে। সেই সেম্পুর বোতল নীতু দুই সপ্তাহে শেষ করেছে।
নীতুকে আমি বললাম,
তুমি খুব ছোট নও। ষোল বছর বয়স তোমার। জীবনে ঢাকা প্রথম এসেছো। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হলেও তুমি খুব আদরে আর বিলাসিতায় বড় হওনি। প্রচুর বাংলা সিনেমা দেখো। ফেসবুকে তোমার তিনটা আইডি। প্রচুর বন্ধুবান্ধব তোমার। নাটক সিনেমা দেখতে দেখতেও বন্ধুদের সাথে কথা বলতে থাকো। এমন কি রাত তিনটা পর্যন্ত মোবাইলে চ্যাটিং করো। কেউ এক গ্লাস পানি চাইলেও দাও না। কোনো দরকারে পাঁচ তলা বা ছয় তলায় যেতে বলা হলেও তুমি যাও না। এগুলো ঠিক না। তুমি এসেছো আমাদের বাসায়। লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকো। সিনেমা দেখা কমিয়ে দাও। মোবাইলে কথা বলা কমিয়ে দাও। লেখাপড়ায় মন দাও। আমার এসব কথা মেয়েটার সহ্য হয়নি। সে ঘরের দরজা লাগিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতে তার হিচকি উঠে গেলো। কিছুতেই সে কান্না থামায় না। ঘরের দরজাও খুলে না। যাই হোক, তাকে শেষমেষ বলা হলো- কোনো সমস্যা নাই। তুমি তোমার মতো থাকো।
বাসার সবাই আমার উপর রাগ করলো।
সবাই বলল ছোট মেয়ে। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে মেয়েটাকে কঠিন কথা বলা ঠিক হয় নাই। আমাকে স্যরি বলতে হবে। আমি নীতুকে বললাম, নীতু তুমি গ্রামেই চলে যাও। ঢাকা শহর ভালো না। গ্রামের পরিবেশ ভালো। নীতু বলল, গ্রামে গোছল করতে হয় পুকুরে। বাথরুম ভালো না। সাবান সেম্পু ছাড়া গোছল করতে হয়। সকালের নাস্তায় থাকে পানি ভাত। সকালের নাস্তায় ডিম পোচ গ্রামে কেউ খায় না। ঘরের ফ্লোর মাটির। রান্না হয় মাটির চুলায়। রান্নার জন্য লাকড়ি আমাকেই টোকাতে হয়। গ্রামে নিউ মার্কেট নাই। গ্রামে গাড়িতে উঠা হয় না। আমি আর কোনোদিন গ্রামে যাবো না। আমি এই বাসাতেই থাকবো। লেখাপড়া করবো। লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরী করবো। তারপর বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে আসবো। আব্বা অন্যের জমিতে কাজ করে। বৃষ্টির দিনে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। গ্রামে পিকজা নেই। অভাব। ইউটিউব নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ২:৩৪