অনেকদিন পর বাবাকে স্বপ্নে দেখেছি।
দুপুরবেলা আমি আরামবাগ থেকে হেটে হেঁটে মতিঝিলের দিকে যাচ্ছি। প্রচন্ড রোদ। তবে বাতাস আছে। তাই ঘামছি না। নটরডেম কলেজের সামনে একলোক আখের রস বিক্রি করছে। এক মগ কুড়ি টাকা। সাথে বরফ দিয়ে দিচ্ছে। কেউ চাইলে কয়েক ফোটা লেবুর রসও দিচ্ছে। খাবো কিনা ভাবছি। এমন সময় দেখি আব্বা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বলল, খেতে মন চাইলে খা।
আমি বললাম, তুমি খাবে?
না।
আমিও খাবো না।
আমি আর আব্বা পাশাপাশি হাঁটতে থাকলাম।
আব্বা বলল, অনেকদিন মনে হয় সেলুনে যাচ্ছিস না।
না যাই না। আমার মনে আছে। তুমি সব সময় জোর করে আমাকে সেলুনে নিয়ে যেতে। দাঁড়িয়ে থেকে চুল কাটাতে। সেলুনওলা অবাক হতো। এত বড় ছেলের চুল কাটাতে নিয়ে এসেছে তার বাবা। গত আড়াই মাস সেলুনে যাই না। অথচ কেউ চুল কাটার কথা বলেও না।
আব্বা বলল, তুই তো অনেক শুকিয়ে গেছিস রে। গায়ে রঙ কালো হয়ে গেছে।
হ্যাঁ ওজন কমে গেছে। এখন আর নিজের যত্ন নিই না। ইচ্ছা করে না। তাছাড়া আমার দিকে কেউ ভালো করে লক্ষ্য করে না। তুমি হুট করে মরে গেলে। আমার জীবনটা বদলে গেলো।
আব্বাকে বললাম, তোমার মনে আছে। একবার জাহাজে করে সুন্দরবন যাচ্ছিলাম। আমি জাহাজের ছাদে উঠেছিলাম প্রচুর বাতাস ছিলো। বাতাসে আমার চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। তুমি পকেট থেকে চিরুনি বের করে আমার মাথার চুল আচড়ে দিয়েছিলে। সেই দৃশ্য দেখে অনেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। এত বড় ছেলের কেউ চুল আচড়ে দেয়! আমার দাঁত ব্যথা করলে কেউ বুঝতো না। কিন্তু তুমি ঠিকই বুঝতে। নিয়ে যেতে ডাক্তারের কাছে। আসলে বাবারা অনেক কিছু বুঝে। তুমি আমাকে খুব বেশি ভালোবাসতে। মনে আছে তোমার তুমি আর আমি প্রায়ই রিকশা করে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। আইসক্রীম খেতাম।
অনেক কিছুই ভুল মেরে বসে আছি রে।
আব্বা এখন আমার মনে হচ্ছে। তুমি আরো অনেকদিন বেঁচে থাকতে। আমরা কেউই তোমার যত্ন করিনি। তুমি অসুস্থ হলে। অথচ আমরা কেউ তোমার দিকে নজর দেইনি। আর তোমারও দোষ আছে, তুমি ডাক্তারের কছে যেতে চাইতে না। হাসপাতালে থাকতে চাইতে না। তবে তুমি সঠিক চিকিৎসা পেলে আরো অনেকদিন বেঁচে থাকতে। তোমার স্বাস্থ্য ভালো ছিলো। ছোটবেলা থেকেই তোমাকে কখনও অসুস্থ হতে দেখিনি। আচ্ছা, আব্বা মৃত্যুর পর তুমি কেমন আছো?
ভালো আছি। আমার সাথে আমার মা বাবা আছে।
আচ্ছা, ভালো কথা তোর মা কেমন আছে?
মা ভালো আছে। সারদিন নাটক সিনেমা দেখে। লুডু খেলে। প্রতিমাসে ২/৩ বার ডাক্তারের কাছে যায়। অনেক ওষুধ খায়।
আব্বা এখন আমি অনুভব করি বাবাদের অনেকদিন বেঁচে থাকা দরকার। বাবা বেঁচে থাকলে ভরসা পাওয়া যায়। মনে সাহস থাকে। বিপদে আপদে অন্তত একজন মানুষ এগিয়ে আসবে, তাকে না ডাকলেও।
আব্বা বলল, এখন আর এসব কথা ভেবে লাভ কি?
আচ্ছা আব্বা তুমি কি তোমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা নিয়েছো?
না নেই নি।
তাহালে ছোট চাচা যে বলে। তুমি টাকা নিয়েছো। সেই টাকার বিনিময়ে তুমি গ্রামের বাড়ি ছোট চাচাকে নিয়ে যেতে বলেছো।
ওরা মিথ্যা বলে।
ছোট চাচা ভয়াবহ মিথ্যাবাদী। আব্বা জমিজমা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
জানি। তুই আমার ছেলে। আমার চেয়ে ভালো তোকে আর কে চিনবে? জানবে? বুঝবে?
আব্বা আমার খুব আফসোস হয়। তুমি আমার কন্যা ফারাজাকে দেখলে না। ফারাজা জন্মের পনের দিন আগে তুমি মরে গেলে।
কে বলে, দেখিনি? তুই ফারাজাকে নিয়ে সন্ধ্যার পর হাঁটতে যাস। আমি জানি তো। দেখি।
আব্বা তুমি মাঝে মাঝে আমার স্বপ্নে এসো। ভালো লাগে। সাহস পাই।
আচ্ছা, যা তুই চাইলেই আমি তোর স্বপ্নে আসবো। তুই আমার অনেক আদরের সন্তান। একবার স্কুলে এক শিক্ষিক তোকে বোকা বলেছিলো। আমি সেদিন স্কুলে গিয়ে তোর শিক্ষক কে বলেছিলাম। আমার ছেলে বোকা নয়। এবং তোকে বোকা বলার কারনে আমি তোকে অন্য স্কুলে ভরতি করিয়ে দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ আব্বা আমার মনে আছে। সেদিন তুমি আমাকে কোলে করে বাসায় নিয়ে এসেছিলে।
আব্বা তোমার কোনো জিনিসপত্র আমার কাছে নেই। শুধু আছে সৃতি।
তোমার অনেক গুলো হাত ঘড়ি ছিলো। এগুলো কার কাছে?
আমার ভাইদের কাছে।
শুনেছি, গাজীপুরে তুমি একটা পুকুর করেছিলে। মাছ ছেড়ে ছিলে।
এসব কিছু আমার মনে নেই।
আব্বা তুমি মাঝে মাঝে ডায়েরী লিখতে। আমি দেখেছি। তোমার সেই ডায়েরী কার কাছে?
জানি না।
আব্বা তোমার হাতের লেখা অনেক সুন্দর ছিলো। অথচ আমার হাতের লেখা একদম বাজে। জানো আব্বা আমি কিন্তু সিগারেট খাওয়া শিখেছি তোমার কাছ থেকে। তোমার মতো সুন্দর করে সিগারেট খেতে আমি আর কাউকে দেখিনি। তোমার সিগারেট ধরার স্টাইল, ছাই ফেলার স্টাইল- দেখে আমি মুগ্ধ হতাম। শেখ মুজিবও এত সুন্দর করে সিগারেট খেতে পারতেন না।
আব্বা বলল, শোন ভালো থাকিস। আমি চলে যাচ্ছি।
যাওয়ার আগে একবার আমার মাথায় হাত রাখবে? প্লীজ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২৩ রাত ৩:০০