লোকটার নাম রমিজ উদ্দিন।
অথচ সবাই তাকে ডাকে বিজু নামে ডাকে। ১৯৭২ সালে বিজু একদিন পদ্মা নদীতে করে বিক্রমপুর চলে আসে। তখন তার বয়স পনের বছর। তার বাবা-মা নেই। দুনিয়াতে তার কেউ নেই। সে বাংলা পড়তে পারে, লিখতে পারে। বিজু বন্ধুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু সে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। শ্রী নগর বাজারের কাছে আসে বিজু। এক কাপড়ের দোকানে সামনে আসে। সে জানে কাপড় ছাড়া মানুষের কোন উপায় নেই। লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড় লাগবেই। এবং এই কাপড়ই একদিন তার ভাগ্য বদলে দেবে। সে কাপড়ের দোকানের মালিককে বলল, বাকিতে আমাকে কিছু কাপড় দেন। আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় বিক্রি করে আপনার টাকা পরিশোধ করে দেবো। দোকান মালিক বলল, আমাকে বোকা মনে হয়? যা ভাগ। ভন্ড। তখন বিজুর সাথে দেখা মোয়াজ্জেম হোসেনের। তিনি বিজুকে কিছু টাকা দেন কাপড়ের ব্যবসা করার জন্য। এই মোয়াজ্জেম হোসেন আমার দাদা।
বিজু কিছু শাড়ি, লুঙ্গি আর গামছা কিনলো।
সে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে এসব বিক্রি করতে লাগলো। তার বিক্রি খুব ভালো হলো। কারন বিজু হাস্যমূখী। কথায় রস আছে। তার গ্রাহক হলো গ্রাম বাংলার সহজ সরল নারীরা। সারাদিন কাপড় বিক্রি করে সে আলামিন বাজারের এক মসজিদে ঘুমায়। বিনিময়ে তাকে মসজিদ দুইবেলা পরিস্কার করে দিতে হয়। টানা পাঁচ বছর বাড়ি বাড়ি শাড়ি, গামছা আর লুঙ্গি বিক্রি করে বিজু নিজেই একটা দোকান দিতে সক্ষম হয়। এর আগে বালাসুর এলাকায় সে এক খন্ড জমি কিনেছে। জমিতে ঘর তুলেছে। দোকান দেওয়ার পর বিজুর বিয়ের শখ হয়। কিন্তু সে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে পায় না। কারন সে হচ্ছে জোলা। জোলার কাছে কে মেয়ে বিয়ে দেবে? একসময় যারা কাঁধে করে শাড়ি লুঙ্গি আর গামছা বিক্রি করতো তাদের জোলা বলা হতো। জোলা বলতে নিচু জাত মনে করা হতো। আমার দাদা বিজুর বিয়ের ব্যবস্থা করে দেন। বিয়েতে দাদা বিজুর স্ত্রীকে একটা সীতা হার উপহার দেন।
সুখের সংসার বিজুর।
দোকানে বেচা বিক্রি ভালো। বিজু আগেই বুঝেছিলো কাপড় মানুষের লাগবেই। একবেলা না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু একবেলা ন্যাংটা থাকা যায় না। বিজুর দুই কন্যা জন্ম হলো। জমজ কন্যা। দেখতে দেখতে মেয়েরা বড় হলো। স্কুল পাশ দিলো। তাদের বিয়ের বয়স হলো। বিজু ধুমধাম করে দুই কন্যার বিবাহ দিলো। খরচে কোনো কার্পন্য করেনি বিজু। এই বিয়েতে আমার বাবা উপস্থিত ছিলো। যাইহোক, দুই কন্যার বিয়ের পর বিজুর স্ত্রী মারা গেলো। বিজু একা হয়ে গেলো। এদিকে এক কন্যাকে দিয়েছে শ্রীনগরের কাপড়ের দোকান অন্য কন্যাকে দিয়েছে গ্রামের বাড়ি। এখন বিজু শূন্য। এজন্য বিজুর মন খারাপ হয় না। কারন সে শূণ্য হাতেই বিক্রমপুর এসেছিলো। তাঁরা মেয়েরা ভালো থাকুক, তাহলেই সে খুশি। তাঁরা জীবন শেষের দিকে। এখন মৃত্যু হলেও সমস্যা নাই। দুই কন্যাকে ভালো পাত্রের সাথে বিবাহ দিয়েছেন। বাকি জীবনটা সে আনন্দ নিয়ে কাটাতে পারলেই খুশি।
বুড়ো বয়সে বিজু নদীর পাড়ে চলে গেলো।
পদ্মানদীর পাড়ে। সেখানে কোনো বাড়িঘর নেই। মানুষের কোলাহল নেই। আছে নির্মল বাতাস। যা মনকে শান্ত করে দেয়। অদেখা ভুবনের আনন্দ পাওয়ায় যায় গভীর রাতে। কামারগাও বাজারের পেছনে এক মাইল হেঁটে গেলেই বিশাল পদ্মানদী। সেখানেই পদ্মার পাড়ে বিজু একটা দোকান দিলো। সেই দোকানেই বিজু ঘুমায়। লোকজন বলাবলি করলো- শেষ বয়সে বিজু গেছে পাগল হয়ে। টানা সাত দিন পার হয়ে যায়, তার পাঁচ টাকার সদাই বিক্রি হয় না। কিনবে কে? সেখানে কোনো বাড়ি ঘর নেই। সে পথ দিয়ে মানুষও যাতায়াত করে না। বিজু চায়ও না তার বেচাকেনা হোক। এই নদীর দিকে তাকিয়ে থাকাতেই তার আনন্দ। মাঝে মাঝে কিছু লঞ্চ চলে যায় ভোট ভোট শব্দ করে। ছোট বড় কিছু নৌকা প্রায় সারাদিনই দেখা যায়। এগুলো মাছ ধরার নৌকা। বিজুর বড় ভালো লাগে। তার অবশ্য একটা দুঃখ আছে। সে তার বাবা মায়ের মুখ মনে করতে পারে না। তাঁরা দেখতে কেমন ছিলেন, সেটা বিজু জানে না।
বিজুর নতুন অভ্যস হয়ে পত্রিকা পড়া।
সে পুরো পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। নদী পাড়ে পত্রিক আরাম করে পড়া যায় না। বাতাস পত্রিকার পাতা ওলট পালট করে দেয়। বিজু নিজের চা বানায়। চায়ে চুমুক দেয়, পত্রিকা পড়ে, নদীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার বড় ভালো লাগে। নদীর পাড়ে কিছু গাছ লাগিয়েছে। সেই গাছের যত্ন নেয়। এই শেষ বয়সে এসে সে অনুভব করে জীবন আনন্দময়। লাইফ ইজ বিউটিফুল। এখন তার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। এখন গ্রামের অনেকেই তার কাছে আসে। গল্প করে। বিজু তাদের চা খাওয়ায়। বিজুর ধারনা সে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। যুদ্ধের ময়দানে সে মুক্তিবাহিনীর সাথে থেকেছে। তার পাশে থাকা লোক গুলিতে মরে গেছে। তার কিচ্ছু হয়নি। খালি হাতে এই অঞ্চলে এসে সে দোকান করেছে, বাড়ি করেছে, বিয়ে করেছে, তার সন্তান হয়েছে। সন্তানদের বিয়ে দিয়েছে। নিজের কথা কখনও ভাবে নি। এই পদ্মার পাড়ে এসে সে যেন নতুন জীবন পেয়েছে। এই জীবনটাই তার কাছে সবচেয়ে আনন্দময় লাগছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২৩ দুপুর ১:৫৬