মানুষের পতনের কোনো শব্দ হয় না।
তবু আশপাশের কিছু লোক ঠিক কেমন করে যেন টের পায়, এ লোকটার দিন শেষ হয়ে এসেছে। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। চিপা চিপা গলি গুলোতে পানি জমে গেছে। আবহাওয়া শীতল। গত কয়েকদিন খুব বেশি রকমের গরম গেছে। মাত্র ঘুম ভাঙ্গল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখা গেলো- সকাল ১১টা। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম হয়নি। শুধু এপাশ ওপাশ। বিছানায় মাথা রাখা মাত্র যাদের ঘুম চলে আসে তাঁরা ভাগ্যবান। আমি ভাগ্যবান নই। জন্মের পর থেকেই ঈশ্বর আমার সাথে শত্রুতা করে যাচ্ছেন। সেটা আজও অব্যহত আছে। যাইহোক, ফযরের আযানের পর ঘুম এলো। ঘুমের সাথে স্বপ্ন। স্বপ্নে নদী, স্টিমার, পুরোনো বাড়ি আর একটা মেয়ের মুখ।
বিশাল একটা প্রাচীন নদী।
নদীর পানি দেখতে কালচে ধরনের। নদীর পাড়ে একটা প্রাচীন বাড়ি। বাড়িটা দেখতে পুরোনো জমিদার বাড়ির মতোন। বাড়ির চারপাশে নানান রকম গাছপালা থাকায় এক ধরনের ভৌতিক পরিবেশ সৃস্টি করেছে। বুঝাই যাচ্ছে বাড়িতে কেউ থাকে না। এপাশের নদীর ঘাট বাঁধানো। ঘাটে সিংহদ্বার দেখা যাচ্ছে। পুকুরের ঘাট বাঁধানো হয় কিন্তু নদীর ঘাট নয়। নদীর ঘাটে একটা বৈঠা ছাড়া নৌকা বাধা। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা স্টিমার আসছে। এই জমিদার বাড়ি, নদীর ঘাট এবং এই স্টিমার আমি আগে কখনও দেখেছি কি? মনে হচ্ছে জমিদার বাড়ির ছাদে একটা মেয়ে আছে। সে স্টিমারের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কে?
এই স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে গেলো।
আবার ঘুমালাম, ঠিক এই স্বপ্নটাই দেখলাম। স্বপ্নটা দেখে আর ঘুম হলো না। একা একা শুয়ে খুব ভয় করতে লাগল। মনে হল, কেউ পাশে থাকলে খুব ভালো হতো। কেমন একা লাগে। রাত-বিরোতে ঘুম ভাঙলে কারো নাম মনে পড়ে না। কাউকে ডাকতে গিয়ে দেখি, মাথা অন্ধকার লাগে। মনে হয় কেউ নেই আমার। সে বড় কষ্ট। নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে নিলাম। জানালা খোলা। সমানে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। পড়ুক। ভেসে যাক সব। এমনিতেই আমার ধারনা- আগামী পনের বছরের মধ্যে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, দুরারোগ্য ক্যান্সার, মহামারী আর এইডস, মারাত্মক ভূমিকম্প, বিশ্বযুদ্ধ, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি- পৃথিবীর জনসংখ্যা বিপুল পরিণামে কমিয়ে দেবে।
যেহেতু হাতে কাজ নেই-
বাইরে বৃষ্টি! তাই স্বপ্নের নদী, স্টিমার, জমিদার বাড়ি ও জমিদার বাড়ির ছাদে যে মেয়েটিকে দেখেছি তাদের কথা ভাবা যেতে পারে। আকাশে কালো মেঘ জমেছে, তাই নদীর পানি কালচে দেখা গেছে। আমার দাদা জমিদার ছিলেন। তার সেই ভগ্ন রুগ্ন ইট বালু খসে যাওয়া জমিদার বাড়িটা রয়ে গেছে। বাড়ির ছাদে যে মেয়েটাকে দেখেছি, তার নাম নীলা। নীলা ব্যাংকে কাজ করতো। প্রতি সপ্তাহে আমাকে কয়েকবার ব্যাংকে যেতে হতো। তখন আমি বিজনেস করতাম। মেয়েটাকে দেখতাম। ভীষন সুন্দর ও সহজ সরল একটা মেয়ে। রোজ শাড়ি পড়ে অফিসে আসতো। মাঝে মাঝে কাজ না থাকলেও আমি ব্যাংকে যেতাম শুধু মাত্র নীলাকে দেখতে। নীলা আমাকে না চিনলেও সে জানতো আমার একাউন্টে ঠিক কত টাকা আছে।
দুই বছর নীলাকে শুধু দেখে গেলাম।
একদিন বিকেলে দোয়েল চত্ত্বের কাছে নীলার সাথে দেখা হয়ে গেলো। সেই শুরু। নীলাই কাছে এগিয়ে এলো। বলল, শুধু দেখে যাওয়া আর কাছে আসা এক নয়। আমি বোকার মতো বলে বললাম, আইসক্রীম খাবেন? নীলা হেসে ফেলল। সহজ সরল সুন্দর হাসি। যে হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। নীলা বলল, আপনার হাতে সময় আছে, তাহলে চলুন আমার সাথে। আমি বাংলা একাডেমী যাচ্ছি। নীলার পাশে নিজেকে প্রাচীন রোমের সম্রাট বলে মনে হচ্ছে। আমি হেটে চলেছি। সেই শুরু আমাদের পথ চলা। ভালোবাসা মনে হয় এভাবেই হয়ে যায়। তারপর একদিন বিছানায় যাওয়া। মাতাল হয়ে যাওয়া, পাগল হয়ে যাওয়া। অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাওয়া।
সদরঘাট থেকে একদিন আমরা স্টিমারে উঠে বসলাম।
নীলার শখ স্টিমারে উঠবে। সে লঞ্চে উঠেছে কিন্তু স্টিমারে নয়। এই নীলাকে নিয়ে এই শহরের এমন কোনো অলিগলি বাদ নেই যাইনি আমার বাইকে করে। সেসময় আমার একটা সস্তার বাইক ছিলো। নীলাকে পাশে বসিয়ে সমস্ত শহর ঘুরে বেড়াতাম। নীলা বলতো বাইক কেউ এত ধীরে চালায়। স্প্রিড বাড়াও। নইলে মজা নেই। নীলা বুঝে না সস্তার বাইক স্প্রিড বেশি হয় না। নীলাকে পাশে বসিয়ে মনে মনে বলতাম, হে আমার প্রিয় বাইক তুমি রাস্তায় বিগড়ে যেতো না। বাইক আমার কথা শুনতো। নীলার চুল বাতাসে উড়ে এসে আমার চোখে মুখে লাগতো। বড় ভালো লাগতো। মিষ্টি একটা গন্ধে আমি বিভোর হয়ে থাকতাম।
ঐ যে বলেছিলাম, আমার ভাগ্য ভালো নয়।
ঈশ্বর আমার সাথে শত্রুতা করে যাচ্ছেন। আজ নীলা আমার পাশে নেই। নীলার বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন পাক্কা সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। তার স্বামী মস্ত ধনী মানুষ। বিরাট ব্যবসায়ী। এদিকে আমি ব্যবসায় ধরা খেয়ে ধরাশায়ী। কিছুতেই আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারলাম না। এটাই আমার জন্য ভালো হয়েছে। নীলা পাশে নেই, আমি ব্যবসা দিয়ে কি করবো? একজন ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে কাজ করে আনন্দ পাওয়া যায়। হ্যাঁ নীলাকে আমি আজও ভালোবাসি। আমৃত্যু ভালোবেসে যাবো। নীলার কোনো দোষ নেই। আমিই দোষী। আমিই অপরাধী।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ২:৪৩