রসুলপুর গ্রামে একটা রেলস্টেশন আছে।
দরিদ্র গ্রাম রসুলপুর। চাষাভুষাদের গ্রাম। দেশভাগের আগে এখানে কোনো লোকজন ছিলো না। পুরো জায়গাটা জংলা ছিলো। উপর থেকে দেখলে দেখা যাবে, গাঢ় সবুজ। কোনো ঘরবাড়ি নেই, রাস্তাঘাট নেই। দেশভাগের কারনে এখানে এসে কিছু দরিদ্র লোক আশ্রয় নেয়। তাঁরা মাটি দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করে। জীবিকার জন্য লোকজন চাষবাস শুরু করলো। দেখতে দেখতে রসুলপুরে বসতি গড়ে উঠলো। দেশভাগের কারনে অভাবী মানুষের স্রোতের সাথে এই গ্রামে মানুষের পা পড়লো। আজ রসুলপুর একটা গ্রাম। এই গ্রামেই থাকে আলামিন। আজকের গল্পটা আলামিনের গল্প।
চব্বিশ ঘন্টায় একবার রসুলপুরে একটা ট্রেন আসে।
ট্রেনের নাম- তিস্তা এক্সপ্রেস। বেশির ভাগ সময় ট্রেন এসে দশ মিনিট অপেক্ষা করে। কোনো লোক উঠে না, নামেও না। সাধারণত ট্রেন স্টেশন গুলো সব সময় জমজমাট থাকে। লোকজন দিয়ে ভরতি থাকে। কিন্তু রসুলপুর গ্রাম বলে কথা। মাত্র একটা চায়ের দোকান এই ষ্টেশনে। চায়ের দোকানের মালিকের নাম আকরাম। সে সারাদিন একতারা হাতে নিয়ে রেলস্টেশনে বসে গান গায়। চায়ের দোকান চালায় তার মেয়ে ঝুমুর। ঝুমুর গ্রামের সহজ সরল মেয়ে। শহরের মেয়েদের মতো তার চোখে মুখে পাপ নেই। তাঁরা চোখে মুখে খেলা করে স্বচ্ছতা। এই দোকানে রোজ এসে লম্বা সময় ধরে বসে থাকে আলামিন নামের এক ছেলে।
আলামিনের বয়স একুশ।
তার বাবা মা নেই। তার একটা কুঁড়ে ঘর আছে মালপাড়ায়। মালপাড়া থেকে রসুলপুর রেলষ্টেশনে হেঁটে আসতে সময় লাগে বিশ মিনিট। আলামিন আসে ঝুমুর কে দেখতে। মেয়েটাকে তার বড় ভালো লাগে। একদম খাসা ডালিমের মতো দেখতে ঝুমুর। ঝুমুরের বয়স ষোল'র বেশী হতেই পারে না। ঠিক ঠিক হিসাব করলে হয়তো তার বয়স আরও কম হবে। আলামিন ঝুমুরকে বলল, এক কাপ চা দাও। অভ্যাস হয়ে গেছে খারাপ। তোমার হাতের চা না খেলে জুইত লাগে না। ঝুমুর বলে, বাবা তোমাকে চা দিতে মানা করছে। তুমি বাকিতে চা খাও। টাকা দাও না। অনেক টাকা জমে গেছে। আলামিন বলল, টাকা পয়সা অতি তুচ্ছ জিনিস। বুঝেছো ঝুমুর?
আলামিন গরীব মানুষ।
তার কোনো সম্পদ নেই। আছে শুধু খিদে। এই খিদে আলামিনকে পাগল করে দেয়। কোনো রকমে একবেলা খাবার জুটলে, পরের বেলার খাবারের চিন্তায় সে মনমরা হয়ে থাকে। আল্লাহ্ যে ক্যান মানুষকে খিদা দিলো। খিদা ছাড়া দুনিয়ার সব কছুই আলামিনের ভালো লাগে। এই যে আজ দুদিন ধরে ভ্যাপসা গরম। অথচ চলছে বর্ষাকাল। চৈত্র মাসের মতো গরম। রোদ নেই। কিন্তু কি সাঙ্ঘাতিক গরম পড়িছে। শরীর ঘামে ভিজে যায়। আলামিনের ভাগ্য খারাপ। মেঘলা বিকেলে ঝুমুর কাছে এলো, এক কাপ চা খাবে বলে। অথচ ঝুমুর বাপ দেওয়ান আকরাম তাকে চা দিতে মানা করে দিয়েছে। চা আলামিনের কাছে কিছুই না। সে আসে ঝুমুরকে দেখতে।
এই গ্রামে একমাত্র রাজ্জাক শেখ পয়সাওলা লোক।
আলামিন গেলো তার কাছে, বলল, আমারে কাম দেন। আমার টাকার দরকার। ঘরের ভিটি পাকা করিবো। রাজ্জাক শেখ একটা পান মুখে দিয়ে বলল, যা তোরে আমার উত্তরের পাঁচ শতাংশ জমি দিলাম। চাষবাস কর। স্টেশনের আকরামের কইন্যারে বিয়ে কর। সুখে থাক। আলামিন খুশিতে রাজ্জাক শেখকে কদমবুসি করে ফেলল। আলামিন স্বপ্নে ভাবেনি রাজ্জাক শেখ তাকে জমি দেবে। তার ইচ্ছা করছে এক ছুটে ঝুমুরকে কাছে যেতে। জমির কথাটা তাকে বলতে। ঝুমুর অনেক খুশি হবে। আলামিন মনে মনে ভাবছে- এইবার আর ঝুমুর কারো জন্য চা বানাবে না। শুধু তার জন্য বানাবে। একজন ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে কাজ করে আরাম পাওয়া যায়।
আলামিন মাটি ভালোবাসে।
সে জানে মানুষ মাটি থেকেই তৈরি। মাটি না থাকলে দুনিয়া থাকতো না। মাটিতে আছে অনেক অজানা রহস্য। মাটি দিয়ে ইট হয়। ইট দিয়ে বাড়ি তৈরি হয়। সেই বাড়িতে মানুষ থাকে। কিছু ধারধেনা করে আলামিন চাষবাস শুরু করলো। সে ফসল ফলাতে জানে। আরো জানে, যত পরিশ্রম তত ফসল। তার জমি ফসল দিয়ে ভরে গেছে। আলামিনের বুদ্ধি আছে। সে জমির চারপাশে ফলের গাছ লাগিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছর পর আসতে শুরু করবে ফল। একটা ছোট পুকুর কেটেছে। পুকুর হলো মাছের খনি। আর জমি হলো ফসলের খনি। গাছ হলো ফলের খনি। দুই তিন বছর পর তারে আয় পায় কে! রাজ্জাক শেখ তার ব্জীবনটা বদলে দিলো।
পাঁচ বছর পরের কথা।
রসুলপুর গ্রাম অনেক বদলে গেছে। আলামিন পাকা ঘর করেছে। এমনকি গরু বাছুরের জন্যও পাকা ঘর করেছে। সাতজন লোক তার হয়ে খাটে। প্রতিদিন সে বিশ কেজি দুধ পায়। দেশী মূরগী আছে তার অনেক গুলো। প্রতিদিন আসে দেশী মূরগীর ডিম। পুকুরে জাল ফেললেই আসে নানা রকম মাছ। জমিতে যে ধান হয়, নিজের জন্য রেখে বাকিটা বাজারে বেঁচে দেয়। মানুষের ভাগ্য বদলে যেতে সময় লাগে না। এই আলামিন এক কাপ চায়ের জন্য ঝুমুরের কাছে গিয়ে বসে থাকতো। সেই ঝুমুরকেই আলামিন বিয়ে করে ফেলেছে। সুখের সংসার তার। তার স্ত্রী গর্ববতী। একদিন আলামিন রাজ্জাক শেখের কাছে গিয়েছিলো, বলেছিলো- আপনি আমার জীবন বদলে দিয়েছেন। রাজ্জাক শেখ শুধু বলেছিলো- সুখে থাকো। আলামিন কদমবুসি করলো।
সুন্দর জোছনা রাত।
জোছনায় যেন রসুলপুর গ্রাম ভেসে যাচ্ছে। সেই সাথে শীতল বাতাস। অতি মনোরম পরিবেশ। দেওয়ান আকরাম একতারা বাজিয়ে গান গাইছেন। বাঁধানো পুকুরঘাটে বসে গান শুনছে আলামিন আর ঝুমুর। ঝুমুরের পাশে বসে আছে এক শিশু। শিশুটা মুগ্ধ হয়ে জোছনা দেখছে। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তার পায়ের কাছে একটুকরো জোছনা এসে পড়েছে। শিশু সেই জোছনা ধরতে চেষ্টা করছে। ব্যর্থ চেষ্টা। জোছনা কখনও ধরা যায় না। তবে সে কখনও কখনও নিজে এসে ধরা দেয়। যার কাছেই ধরা দেবে তার জীবন বদলে যাবে। সবার জীবনে মঙ্গলময় জোছনা নেমে আসুক। সবাই সুখে থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২৩ বিকাল ৫:২৫