অসংখ্য ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে।
মাঝে মাঝে আমি নিজেই প্রচন্ড অবাক হয়ে যাই। একজন সাধারন মানুষের জীবনেও অসাধারন কিছু গল্প থাকে। কিন্তু মানুষটা সাধারন বলে তার অসাধারন গল্প গুলো কেউ জানতে পারে না। যাইহোক, এখন রাত ১২ টা ৪৫ মিনিট। আমি যাচ্ছি সিলেট। ট্রেন খুব দ্রুত চলছে। যেহেতু ট্রেনে আমার ঘুম হবে না। তাছাড়া ট্রেনের ভিতর কিচ্ছু করার নেই এবং হাতে অনেক সময় আছে। তাই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি আগ্রহ নিয়ে।
তখন আমার বয়স ২৪ বছর। বেকার।
সারাদিন নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াই। আড্ডা দেই। রাত করে বাসায় ফিরি। আব্বা খুব চেস্টা করছে যেন আমার একটা চাকরি হয়ে যায়। বছর পার হয়ে যায় কিন্তু চাকরি আর হয় না। আমার বাবা একজন কৃষক। ক্ষমতাবান মামা চাচা আমার নেই। শেষে আব্বা ধারদেনা করে এবং জমি বন্ধক রেখে আমাকে সৌদি পাঠায়। আমাকে নিয়ে আব্বার অনেক স্বপ্ন। আমি তার একমাত্র সন্তান। আব্বা আমাকে অনেক ভালোবাসে। এত বড় হয়ে গেছি, এখনো ভাত খাইয়ে দেয়, গোছল করিয়ে দেয়।
সৌদি গিয়ে বিরাট বিপদে পড়লাম।
আমাকে বলা হয়েছিল শহরের বড় থ্রি স্টার হোটেলের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের চাকরি। অথচ তারা আমাকে নিয়ে যায় বর্ডার এলাকায়। সেই এলাকার নাম হাফার আল বাতেন। চারিদিকে শুধু মরুভূমি। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর দেখা যায় না। তারা আমাকে কাজ দিলো কাঠ মিস্ত্রিরীর হেলপার। কাঠের কাজ কিছুই জানি না। বিশাল বিশাল ফালি ফালি করে কাঠ তারা আমাকে কাধে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে বলল। এই কাজ আমার জন্য না। তবু কোনো উপায় নাই। যা পারি, যতটুকু পারি করে যাই। নিজের চোখে দেখেছি, অসংখ্য বাংগালী সীমাহীন কষ্ট করছে।
আমি এত বড় কাঠ কাধে নিতে পারি না।
আমাকে কুৎসিত গালি দিতো। বারবার বলতো ফিলিপাইনের ছেলেরা পারে, পাকিস্তানের ছেলেরা পারে তুই কেন পারিস না হারামজাদা? সারাদিন প্রচন্ড গরম। হঠাৎ শুরু হয় ধূলিঝড়। পুরো শরীর বালু দিয়ে মেখে যায়। রাতে ঘুমানোর জায়গা ভালো নয়। সবচেয়ে বড় কথা পানির খুব অভাব। সপ্তাহে একদিন এসে পানি দিয়ে যায়। তিন দিনের মধ্যে সব পানি শেষ হয়ে যায়। রাতে আমাদের রান্না করে খেতে হয়। একএকদিন একএকজনকে রান্না করতে হয়। আমি রান্নার কিছুই জানি না। বহু বছর আগের কথা বলছি। শুনেছি এখন সব কিছুতেই অনেক উন্নত হয়েছে।
মাস শেষে মাত্র ৯ শ টাকা বেতন।
নিজের খাওয়া খরচ। গ্রামে আব্বাকে কি পাঠাবো। এদিকে আমার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে। সৌদিতে এটাই নিয়ম। আমার মালিকের ব্যবহার খুব খারাপ। রাতে আমি সব কিছু ভুলে বই পড়ি। ভাগ্যিস আসার সময় কিছু বই সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। সারাক্ষণ ভাবি কি করি, কই যাই! কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পালিয়ে গেলাম। শহরে চলে এলাম। পকেটে একটা টাকা নাই। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। রাস্তায় বসে কান্না করছি। আমরা দরিদ্র ছিলাম। কিন্তু আব্বা নিয়মিত বাজার করতো। কখনও না খেয়ে থাকতে হয় নাই। ইচ্ছা করছিলো কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে দৌড় দেই।
আমার ভাগ্য ভালো। একজন বাংগালীর সাথে দেখা হয়ে গেলো।
তার বাড়ি কুমিল্লা। দাউদকান্দি। নাম মিজান। মিজান ভাই বললেন, প্রায়ই দেখি বাংলাদেশের ছেলেরা রাস্তায় বসে কাদছে। দেশে ফিরে যাওয়ার টাকা নেই। চাকরি নেই। আকামা (ভিসা) শেষ। পুলিশ খুজছে। মিজান ভাই আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। মিজান ভাইয়ের গ্যারেজ আছে। উনি গাড়ির ডেন্টিং পেন্টিং করেন। শহরে বলে কাজের অভাব নেই। গভীর রাত পর্যন্ত মিজান ভাই কাজ করেন। উনি বাংলাদেশ থেকে ছয় জন ছেলে এনেছেন। সবই তাই কুমিল্লা অঞ্চলের ছেলে। ছেলে গুলোকে মিজান নিজের আপন ভাইয়ের মতো দেখেন। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ভালো। দেশের মাটিতে হয়তো কেউ কাউকে সাহায্য করে না। কিন্তু বিদেশের মাটিতে বুকে জড়িয়ে ধরে। বড় অদ্ভুত।
এখন আমি বেশ সুখে আছি।
খাওয়া দাওয়ার কোনো সমস্যা নেই। ঘুমের সমস্যা নেই। আমার রুমে এসি আছে। মিজান ভাই প্রতিদিন সামান্য কিছু হাত খরচও দিচ্ছেন। মিজান ভাইয়ের গ্যারেজে একটা ফ্রিজ আছে। ফ্রিজ ভরতি নানান রকম পানিও। সারাদিন আমি মিজান ভাইয়ের গ্যারেজের অফিসে বসে থাকি। সুন্দর দিন কেটে যাচ্ছে। মিজান ভাই বলেছেন, তিনি আমার পাসপোর্ট উদ্ধার করে দিবেন। এবং আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিবেন। মিজান ভাই যেন ফেরেশতা হয়ে আমার জীবনে এসেছেন। একদিন নামাজের সময় আমি বাইরে দাড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ এসে আমাকে মারতে শুরু করলো। আর অকথ্য ভাষায় গালাগালি। নামাজের সময় আমি কেন বাইরে। সৌদি বাজে একটা দেশ। এরচেয়ে আমাদের দেশ অনেক ভালো।
একদিন দুপুর বেলা আমি মিজান ভাইয়ের গ্যারেজে বসে গান শুনছি।
মিজান ভাই গেছেন গাড়ির পার্টস আনতে। গ্যারেজে আমি একা। হঠাৎ এক মহিলা এলেন তার গাড়ি নিতে। মিজান ভাই আমাকে আগেই বলে গেছেন। মহিলা গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি বললাম, টাকা। আপনার সাত হাজার টাকা বিল। মহিলা বললেন আমার সাথে টাকা নেই। তুমি আমার সাথে বাসায় চলো। আমার বাসা কাছেই। আমি মহিলার সাথে তার বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে দোতলায় গেলেন। আমার জন্য নাস্তা নিয়ে এলেন। আমি খেলাম। তারপর মহিলা আমাকে টাকা দিবে বলে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেলো। ধনী মহিলা! টাকা না দিয়ে মহিলা তার বোরকা খুলে ফেলল। মহিলা পুরো উলঙ্গ। হায় কপাল!
ভয়ে আমার কলিজা কেপে উঠলো।
তবে মিথ্যা বলব না। মহিলার শরীর অনেক সুন্দর। ভালো স্বাস্থ্য। ধবধবে ফর্সা। বক্ষটা অতি মনোরম। বিয়ের পর ঝুলে যাওয়া রমনীর স্তন নয়। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মতোন। লোভ হচ্ছিল। মহিলা বলল, আমি টাকা দিতে পারবো না। টাকার বদলে তুমি আমার সাথে থাকো। অনেক আনন্দ পাবে। আমি বললাম আপনি কি দরিদ্র? মহিলা হাসলেন। বললেন, আমি ধনী মানুষ। সম্পদের আমার অভাব নেই। আমার স্বামী আমার সাথে থাকে না। সে আরেকটা বিয়ে করেছে। মহিলার জন্য আমার ভীষণ মায়া হলো। অবচেতন মন বার বার বলছে, রাজীব সব কিছু ভুলে যাও। আপাতত এই নারী সঙ্গ উপভোগ করো। কি করবো বুঝতে পারছি না। আমার মাথা কাজ করছে না।
মহিলার নাম ফাতিমা।
ফাতিমার বাড়ি থেকে বের হয়েই আমি পুলিশের হাতে ধরা খেলাম। আমার পাসপোর্ট যার কাছে ছিলো অর্থাৎ যার কাঠের কোম্পানিতে কাজ করতাম। তিনি আমার নামে মামলা করেছেন। ভয়াবহ অবস্থা। সৌদির কারাগার উন্নত নয়। ভীষণ কষ্ট। পুলিশ খুব মারে। যেসব খাবার খেতে দেয়, সেটা গলা দিয়ে নামে না। মিজান ভাই একদিন দেখা করতে এলেন। খুব কান্না করলেন। হয়তো আমার দশ বছরের জেল হয়ে যাবে। এদিকে আমি জানি না আমার বাবা কেমন আছে? মনে হচ্ছে সৌদির কারাগারেই আমার মৃত্যু হবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে একদিন কারাগারে ফাতিমা এলেন। এবং বললেন, তোমার কোনো চিন্তা নেই। সাত দিনের মধ্যে আমি তোমাকে বের করবো। আল্লাহর কসম। প্রয়োজনে আমি আমার বাড়ি গাড়ি সব বিক্রি করে দিবো।