
আমাদের পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটে এসেছে।
নতুন বলতে প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। স্বামী স্ত্রী আর দুই ছেলে। প্রতিদিন দুইবার স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করে। একবার সকালে, একবার রাতে। লোকটার সাথে আমার পরিচয় আছে। বারান্দায় গেলে লোকটার সাথে আমার দেখা হয়। লোকটা মাত্রই স্ত্রীর সাথে চিল্লাচিল্লি করে এসে বারান্দায় সিগারেট ধরিয়েছে। বললাম, কি হয়েছে? লোকটা বলল- এমন এক মহিলাকে বিয়ে করেছি ভাই, জীবন শেষ। বললাম, কি হয়েছে? লোকটা বলল- ভাত খেতে বসেছি। তরকাতি নেওয়ার জন্য আমাকে স্যুপের বাটির চামচ দিয়েছে। আপনিই বলেন, স্যুপের বাটির চামচ দিয়ে তরকারী নেওয়া যায়? আমি বললাম, থাক বাদ দেন। লোকটা বলল, আমি ভদ্রলোকের সন্তান। চিল্লাচিল্লি করা আমার স্বভাব নয়। কিন্তু এই বেটি, এমন সব কাজ-কারবার করে যে, আমার মত শান্ত স্বভাবের মানুষের মাথায় রক্ত উঠে যায়। আফসোস, বিরাট আফসোস। কেন যে বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করলাম না!!
আরেক দিনের কথা-
সকালবেলা ভদ্রলোক রাগ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোস ফোস করে সিগারেট টানছে। বললাম, কি হয়েছে। লোকটা এক আকাশ হতাশা ও কষ্ট নিয়ে বলল, আমার স্ত্রী বলেছে- আমি নাকি ছাগলেরও অধম। আমি হেসে বললাম- আপনি সহজ সরল ভালো মানুষ। লোকটা মন খারাপ করে বলল- আমার স্ত্রী বলেছে, আমি 'ছাগলেরও অধম'। কোনো স্ত্রীলোক তার স্বামীকে বলতে পারে- ছাগলেরও অধম!! আমি বললাম, কোনো অপরাধে আপনাকে এই কথা বললো? লোকটা বলল, অপরাধ লাগে না। মহিলার মন চেয়েছে, বলে দিয়েছে। আমার জায়গায় অন্য কোনো লোক হলে এখন এই বেটিকে টেনে হিচড়ে বাসা থেকে বের করে দিতো। আমি ভদ্র লোকের ছেলে। আমি তো ভাই খারাপ ব্যবহার করতে পারবো না। খারাপ গালাগালি দিতে পারিব না। লোকটা আরেকটা সিগারেট ধরালো। আমি জানি এবং বিশ্বাস করি- একজন স্ত্রী তার স্বামীকে সবচেয়ে ভালো চিনে, জানে এবং বুঝেও।
এই লোকের স্ত্রীকে আমি চিনি।
আমাদের বাসায় অনেকবার এসেছে। ভালো একটা মেয়ে। হাসিখুশি। সহজ সরল, ভোলাভালা। সুরভির সাথে খুব ভাব। যখনই আমাদের বাসায় আসে- ফারাজার জন্য কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে আসে। আমি ভেবে পাই না- এই মেয়ে কেন তার স্বামীকে 'ছাগলের অধম' বলেছে? কেন তরকারী নেওয়ার জন্য স্যুপের চামচ দিয়েছে? কেন তাদের প্রতিদিন ঝগড়া হয়? সমস্যাটা কোথায়? অন্যের সমস্যা বাদ দিয়ে আমি নিজের পরিবার নিয়ে ভাবি। আমি পরিবার নিয়ে ভালো আছি। ঝামেলাহীন জীবন পার করে দিচ্ছি। সুরভির সাথে ঝগড়া হয় না। চিল্লাচিল্লি হয় না। সংসারে শান্তির জন্য মন্ত্র জানতে হয়। মন্ত্রটা হচ্ছে 'ছাড়' দেওয়া। স্বামী স্ত্রী দুজনকেই 'ছাড়' দিতে হবে। 'ছাড়' দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। দুজনে মিলে যত 'ছাড়' দিবে, সংসার তত আনন্দময় হয়ে উঠবে।
ছোটবেলা আমি আমার বাবা মাকে ঝগড়া করতে দেখেছি।
তখনই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি কোনোদিন স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করবো না। আমার বাবা মার মধ্যে ভালোবাসার অভাব নেই। কিন্তু হঠাত ধুমধাম ঝগড়া লেগে যায়। দুজনে হয়তো ভিসিআরে সিনেমা দেখছে। হাসছে। আব্বা বলল, চা দাও। মা চা করে দিলো। আব্বা বলল- চিনি বেশি হয়েছে। তুমি জানো না আমি চিনি কম খাই। মা বলল, হয়তো সামান্য বেশি হয়েছে। কি করবো? খেয়ে ফেলো। তখন আব্বা বললো, কাপও তো সামান্য ভাঙ্গা। ভাঙ্গা কাপে আমাকে চা দাও! মা বলে কই ভাঙ্গা? এটা একটা দাগ। এরকম এক কথায়, দুই কথায় মা বাবা ঝগড়া শুরু করে দেয়। এরপর আব্বা রাগ করে বাইরে চলে যায়। আমি জানি মায়ের মন মেজাজ খারাপ। তাই নিজেই ভাত বেড়ে খেয়ে নিই। লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে যাই। সকালে স্কুল আছে।
ঝগড়া অতি কুৎসিত একটা বিষয়।
ঝগড়া করে শেষমেশ কিছুই পাওয়া যায় না। তবু মানুষ ঝগড়া করে। নিয়মিত ঝগড়া করে। প্রতিদিন রাস্তাঘাটে আমি অসংখ্য ঝগড়া করি। ঝগড়া না করে একপক্ষ চুপ থাকলেই তো ঝগড়া মিটে যায়। সবাই সবার সাথে ঝগড়া করছে। বাস কন্টাকটর পাঁচ টাকার জন্য ঝগড়া করছে, রিকশাচালক যাত্রীর সাথে ঝগড়া করছে, উলটো পথে আসা গাড়ির ড্রাইভার ঝগড়া করছে, ট্রাফিক পুলিশ ঝগড়া করছে, সরকারি চাকরি করা মহিলা ব্লগার ঝগড়া করছে। আমি ভাই কারো সাথে ঝগড়া করি না। কেউ ঝগড়া করতে এলেও আমি চুপ থাকি। ঝগড়াটে মানুষ থেকে আমি একশ হাত দূরে থাকি। আমি শান্তি প্রিয় মানুষ। কেউ আমাকে ঠকালেও আমি ঝগড়া করি না। ক'দিন আর বেঁচে থাকিব এই পৃথিবীতে? তাহলে ঝগড়া কেন করিব?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১০:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




