ধর্ষণ হলো সম্মতিবিহীন জবরদস্তি যা একটি গুরুতর অপরাধ, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বিয়ে হচ্ছে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্র জীবনযাপনের নৈতিক এবং আইনী অনুমোদন। কিন্তু গত নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের তিনটি জেলায় ধর্ষণের মামলার আসামির সঙ্গে ধর্ষণের শিকার তরুণীর বিয়ে হয়েছে এবং তা হয়েছে আদালতের সম্মতিতে ।
গত ২৭ মে জেলার সোনাগাজীর চরদরবেশ এলাকার এক তরুণীকে ধর্ষণ করে জহিরুল ইসলাম জিয়া নামে এক ইউপি সদস্যের ছেলে। এর পরদিনই ওই তরুণী নিজে থানায় হাজির হয়ে ধর্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। একপর্যায় ২৯ মে ধর্ষক জিয়াকে আটক করে সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশ। পরে অভিযুক্তের পরিবার জামিনে মুক্তি পেলে বিয়ে করবে শর্তে ধর্ষকের জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করে।লাখ টাকা দেনমোহরে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতা থেকে মুক্তি পেতে এবার হাইকোর্টের নির্দেশে ফেনী জেলা জেলা কারাগারের আয়োজনে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আরেকটি হলো , ১৮ অক্টোবর রাতে নাটোর জেলার (১৮ অক্টোবর) উত্তরপাড়া গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে মানিক হোসেন একই এলাকার সম্পা খাতুন নামে ওই তরুণীর ঘরে প্রবেশ করে তাকে ধর্ষণ করে। এরপর ১৯ অক্টোবর সেই তরুণী বাদী হয়ে গুরুদাসপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। এদিনই ধর্ষক মানিক হোসেনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। পরে নাটোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক তরুণীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর ধর্ষক মানিক হোসেনের জামিন মঞ্জুর করেন। এনিয়ে আদালত পাড়ায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
ধর্ষণ মামলায় আট বছর ধরে কারাগারে বন্দী দিলীপ খালকো ২০১২ সালে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। ধর্ষণের শিকার ওই নারী আদালতে বলেন, আসামিকে জামিন দিলে তার আপত্তি নেই। আদালত কারাফটকেই তাদের বিয়ের আদেশ দেন।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনব্যবস্থায় ধর্ষণের অপরাধ ভিক্টিমকে বিয়ের মাধ্যমে আপসযোগ্য নয়। ধর্ষণের শিকার তরুণীরআত্মীয়-স্বজন কিংবা স্বয়ং ভিক্টিমদের অনেকে অপরাধীর সাথে বিয়েতে সম্মতি দেন মূলত সামাজিক ও আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে। আমাদের দেশে ধর্ষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ নারীকে উল্টো সামাজিক লাঞ্চনা ও কলঙ্কের সম্মুখীন হতে হয়, ধর্ষণের শিকার নারীর পরবর্তীতে বিয়ে ও সামাজিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে অজস্র প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান, এদেশে বিচারপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া আর্থিকভাবে ব্যয়বহুল, হয়রানিপূর্ণ এবং আইনের নানান প্যাঁচে পড়ে ও ক্ষমতা কাঠামোর প্রভাবে শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার না পাওয়ার সমূহ আশঙ্কা– এসব কিছুই একজন ভিক্টিম কিংবা তাঁর পরিবারকে ‘বিয়ের মাধ্যমে সমঝোতা’ করতে বাধ্য করে। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ এর ক্ষেত্রে বাদীর মূল চাওয়াই থাকে বিয়ের দাবি এবং সম্পর্কের স্বীকৃতি; অভিযুক্তের শাস্তি নয়। অন্যদিকে জোরপূর্বক ধর্ষণে ‘জোর’ আছে; ‘প্রেম’ নেই। উচ্চ আদালত হয়তোবা এই আদেশটি বাদীর সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে দিয়েছেন এর ফলে জোরপূর্বক ধর্ষণ এবং বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ এই দুটোর মধ্যে আইনি প্রতিকারের বেলায় প্রথমবারের মতো পার্থক্য সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে। যে ধর্ষক একজন নারীর অসম্মতিতে জোর করে ধর্ষণ করে আবার সেই ধর্ষকের সাথে নারীর বিয়ে দেওয়া মানে সেই নারীকে আবারো অসম্মান এবং অনিশ্চিত জীবনের দিকে জীবনটাকে চিরতরে ধ্বংস দেওয়া ।
আমাদের দেশে আইন প্রণয়নকারী ও প্রয়োগকারী যাই হোক কিন্তু ধর্ষকের সাথে কখনোই আপোষ নয়।