সেদিন হঠাৎ শিকদার পাড়ার ললিত বর্মণের সাথে দেখা হয়ে গেল । প্রায় ৩৬ বছর পর। এমনি করে ৩৬ বছর আগে একবার ওর সাথে দেখা হয়েছিল জলপাইগুড়ি শহরে। যে বছর চাকরি পেলাম LIC-তে। ও তখন বাংলাদেশ থেকে এসে টুকটাক এটা সেটা করছে। স্থায়ী কোন চাকরী হয়নি। শহরের রাস্তায় আচমকা ওকে দেখে কী আশ্চর্য যে হয়েছিলাম। তারপর ওকে আমার মেসে ডেকে নিয়ে এসে অনেক গল্প, আড্ডা হল। ছবি তোলা হল।
মাঝে ওর আর কোন খোঁজ নেই। শুনেছিলাম ও কোচবিহার শহরে থাকে। ব্যস এইটুকুই। না বাড়ির ঠিকানা অথবা কর্মস্থলের হদিশ। কী করে খোঁজা যায়! আমার কোচবিহারের কমরেডদের সাথে যখনই দেখা হয়েছে, বলেছি ওর কথা। ওরা অনেক চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু পারেনি। আমার নিজেরও কখনো ঐ শহরে যাবার সুযোগ ঘটেনি।
গত বৈশাখ মাসের এক পড়ন্ত বিকেলে কোচবিহার শহরে ওর বাড়ী খুঁজে পাই LIC য়েরই এক ব্যক্তির সহায়তায়। অনেকটা জমি নিয়ে ওদের বাড়ী। সামনেটা লন। পেছনে বাংলো প্যাটার্নের একতলা বাড়ী। লনে পাড়ার বৌ-ঝিরা বসে বিশ্রম্ভালাপ করছিল। ললিতের খোঁজ করতেই একজন দৌড়ে বাড়ীর মধ্যে ঢুকে গেল। খানিক পরে যে ব্যক্তি বারান্দায় এসে দাঁড়াল, স্বল্প আলোতেও আমার চিনতে বাকী রইল না যে, সে-ই ললিত। কারণ বয়সের ছাপ ওর চেহারায় অতি অল্পই পড়েছে। আমি ধীর পায়ে লন পেরিয়ে আসতে আসতে চেঁচিয়ে বললাম - কীরে ব্যাটা, চিনতে পারছিস? বলত, আমি কে?
ওর চোখে মুখে স্পষ্টতঃই কিছুটা হতচকিত অবস্থা দৃশ্যমান হল। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। হাত চারেকের মধ্যে এগিয়ে আসতেই ও চেঁচিয়ে উঠল, প্রদীপ না? আমি এক দৌড়ে উপরে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। দুজনের কন্ঠ থেকেই তখন অস্ফুট সব ধ্বনি বেরতে লাগল। খেয়াল করিনি কখন যেন ওর পাশে ওর স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছে। ও আমাদের কান্ড-কারখানা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। সম্বিত ফিরে এলে আমরা ওর বৈঠকখানায় এসে বসলাম। এই ৩৬ বছরের যত কথা সব ভিড় করে আসতে লাগল একসঙ্গে। ওর স্ত্রী বীণা শুধু হেসেই যাচ্ছে। কিছু পরে সন্দেশ-বিস্কুট এল। চা খাই না বলে কফি এল। আটটার দিকে বীণা ওর কানে কানে কী যেন বলল। ললিত বলল, তুই কিন্তু আজ খেয়ে যাবি। আমি বললাম, সে দেখা যাবে। ও বলল, বীণা রান্না শুরু করে দিয়েছে, বেশি দেরী হবে না। তোর ব্যাগপত্র কোথায়? রাতে থাক। সারা রাত গল্প করা যাবে।
আমি বললাম, না-রে আমাকে ফিরতে হবে।
ললিত বলল, উঠেছিস কোথায়?
এল-আই-সি'র গেস্ট-হাউসে।
ও সে জায়গা আমি চিনি। এখান থেকে রিক্সা ধরে দেব'খন। কোন অসুবিধে হবে না। আর রিক্সা না পাওয়া গেলে বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে আসব।
এর পরে আর কথা চলে না।
অল্প সময়ের মধ্যে বীণা চমৎকার রান্না করে ফেলল। ডাল ভাত দু'রকম ভাজা। কোয়াশের তরকারী ও মাছ ছিল ও' বেলার, আবার ডিমের ওমলেট।
আমি একটু বকলাম ওকে এত খাটা খাটনির জন্য। সামান্য আহার করি। তার জন্য এত আয়োজনের কি সত্যি প্রয়োজন ছিল?
যাহোক, খেয়ে দেয়ে বিদায় সেরে যখন লনে পা রাখলাম তখন ঘড়িতে দশটা বেজে গিয়েছে। এত রাতে রিক্সা পাওয়ার আর কোন চান্স নেই মনে করে ললিত ওর হিরো-হন্ডা খানা বের করে তাতে স্টার্ট দিয়ে ফেলল। বীণার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে তার স্বামী এত রাতে ৫ কিমি পথ একা ফিরবে বলে।
ললিত তার কথা কানে না নিয়ে আমাকে পেছনে উঠতে বলে গাড়ী হাঁকিয়ে দিল জোরে। পেছনে একটা কথা শুধু শোনা গেল, সাবধানে চা..লি..ও।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



