কাগজের ভাঁজটা খুললো ফাহমিম। হুম! সে যা ভেবেছে তাই, চৈতীর রেখে যাওয়া চিঠি, চিঠি না বলে চিরকুট বলাই ভালো, কারণ কাগজটাতে অল্প কয়েকটা কথাই লেখা শধু--
"গতরাতে আমি আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি, জ্বালিয়েছি; তাই আর বিরক্ত করতে চাইনি দেখে আপনাকে না বলেই আমি চলে গেলাম, আমাকে দয়া করে ভুল বুঝবেন না, আপনি আমার যত বড় উপকার গতরাতে করেছেন তার প্রতিদান আমি দিয়ে যেতে পারলাম না, তবে যদি কোন দিন সুযোগ আসে এর প্রতিদান আমি অবশ্যই দিবো। চিরকৃতজ্ঞ হয়ে আজ বিদায় নিলাম আপনার কাছ থেকে। ভালো থাকবেন।"
---চৈতী।
এতক্ষণ চৈতীর প্রতি মনে যে ক্ষোভ জমেছিলো ফাহমিমের, তার সবটাই এক নিমিষে নাই হয়ে গেলো। উল্টো মেয়েটার জন্য কেমন যেন মায়া লাগতে শুরু করলো তার। আহারে বেচারী! কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে কে জানে!--ভাবতে ভাবতেই মনটা কেমন যেনো খারাপও হয়ে গেলো ফাহমিমের।
ফাহমিম চৈতীর ব্যাপারটা প্রায় ভুলতেই বসেছিলো। চৈতী চলে যাওয়ার প্রায় দিন বিশেক পরের ঘটনা। ফাহমিম অফিসে কাজ করছে। এমন সময় তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। নাম্বারটা চিনতে পারলো না ফাহমিম। অচেনা নাম্বার। সে ফোনটা রিসিভ করলো। ওদিক থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসলো। আওয়াজটাকে কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো ফাহমিমের, কিন্তু ঠিক মতো নিশ্চিত হতে পারছিলো সে ওপাড়ের মেয়েটির ব্যাপারে।
মেয়েটা বললো, "আমাকে চিনতে পারছেন?"
ফাহমিম বললো, "জ্বি, একটু চেনা চেনা তো লাগছেই, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না, কে বলুন তো আপনি?"
মেয়েটা ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললো, "আহা এতো উতলা হচ্ছেন কেন? ভেবেই দেখুন না, আপনার পুরানো কোন বান্ধবী হতে পারি।"
ফাহমিম বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, "নারে ভাই, আমার কোন বান্ধবী কোন কালেই ছিলো না, সেই ভাবনা বাদ, আপনিই বলে ফেলুন না আপনি কে?"
মেয়েটা আগের মতোই একটা হাসি দিয়ে বললো, "আপনি তো দেখি ভারী ভুলো মনের মানুষ, কয়েকদিন আগেই তো দেখা হলো, এরই মাঝে ভুলে গেলেন?"আচ্ছা থাক্ আপনাকে আর ভাবতে হবে না; আমি চৈতী।"
আকাশ থেকে যেন পড়লো ফাহমিম, সে ধরেই নিয়ে নিয়েছিলো এই জীবনে আর চৈতীর সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ বা কথা বার্তা হবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ফাহমিম, ততক্ষণে ও প্রান্ত থেকে আবার চৈতী কথা বলতে শুরু করলো, "হ্যালো, আছেন আপনি? শুনুন সেদিন অস্থিরতার মাঝে তো আর আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করা হলো না, নামটা বলুন আপনার।"
এবার ফাহমিম বলতে শুরু করলো, "আচ্ছা মানুষ তো আপনি, কিছু না বলেই চলে গেলেন কেন সেদিন, আপনার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিলো, শেষ পর্যন্ত আপনার চিঠিটা পেয়ে রাগটা একটু কমেছে।"
ফাহমিমের কথা শুনে চৈতী অপরাধমাখা গলায় বললো, "আমি সত্যিই সে জন্য খুবই লজ্জিত, কিন্তু কি করবো বলুন, আমি ভেবেছিলাম আপনাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না, আপনি ঘুমুচ্ছিলেন, তাই আর আপনাকে জাগাইনি, মাইন্ড করবেন না প্লিজ, আমার ভুল হয়ে গেছে , ক্ষমা করুন।"
ফাহমিম বললো, "না না, ঠিক আছে, ক্ষমা চাওয়া লাগবে না, আমি এমনিই একটু মজা করছিলাম। তো কি মনে করে হঠাৎ ফোন করলেন?"
চৈতী বললো, "ভাবলাম আপনার নাম্বারটা যেহেতু আমার কাছে আছেই, একটু খোঁজ-খবর নিয়ে দেখি, রাগ টাগ করলেন কিনা, তাছাড়া আমার এতো বড় একটা উপকার করলেন, আপনার প্রতি এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ তো আমি দেখাতেই পারি, তাই না?"
ফাহমিম তৎক্ষণাৎ বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই। তো আপনি এখন আছেন কোথায়?"
প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলো চৈতী, তারপর কেমন যেন অস্ত্বিতকর গলায় বললো, "আমি আসলে এখন আছি আমার এক বান্ধবীর বাসায়। ওর এখানে আরো কিছুদিন থাকবো। দেখি কি হয়, তত দিনে যদি বাবার সুবুদ্ধির উদয় হয়।"
ফাহমিম হাসতে হাসতে বললো, "হুম, বুঝতে পারছি, আপনি তাহলে এখনো ফেরারী।"
চৈতী ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, "তা বলতে পারেন। শুনুন আপনি কিন্তু আপনার নামটা এখনো বলেন নি।"
ফাহমিম তড়িঘড়ি করে বললো, "খুবই সরি, আমার নাম ফাহমিম।"
চৈতী বললো, "তো ঠিক আছ ফাহমিম ভাই, আজ তাহলে রাখছি, পরে না হয় কথা হবে, যে নাম্বারটা থেকে ফোন করেছি এটা আমার। সময় করে ফোন করলে খুশি হবো"
ফাহমিম বললো, "অবশ্যই, আমি ফোন করবো, ভালো থাকবেন আপনি, আর নতুন কোন খবর হলে জানাবেন কিন্তু।"
চৈতী বললো, "জ্বি আচ্ছা, ভালো থাকবেন ফাহমিম ভাই, রাখি তাহলে, bye।"
আপনিও ভালো থাকবেন বলে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো ফাহমিম। নিজের মনে মনেই কিছুক্ষণ চৈতীকে নিয়ে ভাবলো সে। মেয়েটাকে তো ভালোই মনে হচ্ছে, বেশ মিশুক প্রকৃতির।ভাবতেই ভাবতেই নিজের কাজে আবার মনযোগ দিলো সে
এরপরে অনেক দিনই করি করি করেও চৈতীকে আর ফোন করা হয়ে উঠেনি ফাহমিমের। শেষে একদিন চৈতীই আবার ফোন দিলো, ফোন দেয়ার পর অবশ্য ফাহমিম কিছুটা অপরাধবোধে ভুগেছিলো চৈতীকে ফোন দেয় নি বলে। চৈতীকে সে তা তৎক্ষণাৎ বলেছেও। চৈতী হেসেই বলেছে, "দেননি তো কি হয়েছে? এবার থেকে দেবেন।"
এরপর থেকে মাঝে মধ্যেই ফাহমিম চৈতীকে ফোন দেয়া শুরু করলো। চৈতীও ফোন করে মাঝে মাঝে। দুই জনের সখ্যতাটা বেড়েই চলেছিলো বৈকি। নিয়ম রক্ষার সম্পর্কটা বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্কেও গড়িয়ে গেলো অল্প দিনের মধ্যে। দুই জন দুইজন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে আরম্ভ করলো এবং সম্পর্কটা ধীরে ধীরে আরো গাঢ়ও হতে শুরু করলো। আগে যেখানে কিছুদিন পর পর কথা হতো আস্তে আস্তে সেটা প্রতিদিনের পর্যায়ে চলে আসলো। তারা একে অপরের প্রতি নিজেদের ভালো লাগার কথাও কম বেশী বলতে আরম্ভ করলো। ফলে প্রতীক্ষার ক্ষণগুলোও বাড়তে থাকলো আপন তালে। এক সময় প্রতিবেলাতেই কথা হওয়া শুরু হলো ওদের। দিনে যখন অফিসে থাকে ফাহমিম তখন অল্পক্ষণ কথা হলেও রাতভর আড্ডাটা ভালোই জমতে শুরু করে এক সময়। এক পর্যায়ে দুই জনই বুঝতে পারে তারা একে অপরের প্রতি দুর্বল হতে শুরু করে এবং এটা যে ভালোবাসারই নামান্তর তা বুঝতেই দুই জনের কারোরই তেমন একটা সমস্যা হলো না। ততোদিন শুধুই ফোনে কথা হতো ওদের, শেষে ফাহমিম যখন চৈতীর সাথে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে উঠলো, চৈতী মন খারাপ করে বললো যে সে চট্রগ্রাম এক দুঃসম্পর্কের বোনের বাসায় আছে। তার বাবার মাথা থেকে বিয়ের ভুতটা নেমে না যাওয়া পর্যন্ত সে ঢাকায় আসতে পারবে না। কথাটা শুনে ফাহমিমের মনটা খারাপ হয়ে গেলেও প্রগাঢ় ভালোবাসার টানে সে আর চৈতীকে জোরাজুরি করতে পারেনি। অগত্যা দুরালাপনীর এই প্রান্ত হতে ওপ্রান্তে হাওয়ায় হাওয়ায়ই ভেসে বেড়াতে লাগলো ভালোবাসার অকূল সাগরে ভেসে যাওয়া ফাহমিম আর চৈতীর বাঁধভাঙ্গা প্রেমোচ্ছ্বাস।
এরই মধ্যে মাস তিনেক কেটে গেছে। চৈতী আর ফাহমিম এখন এক আত্মা। প্রেমময় দিনগুলোর সুবাধে ফাহমিমের রোজকার সংগ্রাম আর আগের মতো পীড়াদায়ক নয়।এখন সে বেশ ফুরফুরে মেজাজে অফিস করে এবং ফুরফুরে মেজাজে অফিস থেকে ফিরে আসে।প্রতিদিনকার মতো আজকেও খুব ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই ফাহমিম বাসায় ফিরেছে। একটু পরেই চৈতিকে ফোন দিবে সে। তবে আজকে তার মেজাজ ভালো হওয়ার অন্য একটা কারণ আছে। বাড়ি থেকে মা ফোন করেছিলো আজ। মাকে চৈতীর কথা বলেছে সে। মা সব শুনে চৈতীকে দেখতে চেয়েছে, এই জন্যই ফাহমিমের মনটা আজ একটু বেশীই খুশি। সে বাসায় ফিরেই গোসল করেছে, নিজের হাতে চা বানিয়ে সে চা খেয়েছেও ব্যাপক আনন্দ নিয়ে। এখন বাজে রাত সোয়া আটটার মতো। আর পনেরো মিনিট পরেই তার চৈতিকে ফোন দেয়ার কথা। চৈতীর যেন কি একটা কাজ আছে, তাই সে ফাহমিম কে বলেছে সাড়ে আটটার দিকে ফোন দিতে। ফাহমিম তাই বার বারই প্রবল অস্থিরতা নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সাড়ে আটটা বাজার অপেক্ষায়।এমন সময় তার দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো। খুব আরাম করে শুয়ে ছিলো ফাহমিম, তাই যথেষ্ঠ বিরক্তি নিয়েই সে দরজাটা খুললো। দরজাটা খুলেই একটু হতচকিয়ে গেলো ফাহমিম। চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বেশ গম্ভীর মেজাজে।
ফাহমিম ভুরু কুঁচকে বললো, "কে আপনারা? কি চাই?"
লোকগুলোর একজন বললো, "আপনি কি ফাহমিম?"
ফাহমিম মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, "হ্যাঁ, আমিই ফাহমিম। কেন বলুন তো?"
অপর একজন লোক তার শার্টের উপর ঝোলানো ব্যাজটা দেখিয়ে বললো,
"আমরা ডিবি অফিসার, আপনার বিরুদ্ধ ওয়ারেন্ট আছে, আপনি মাস তিনেক আগে এক রাতে চৈতী নামে কাউকে আশ্রয় দিয়েছিলেন এখানে?"
হতবম্ব ফাহমিম কিছুক্ষণ শূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে ক্ষীণ গলায় বললো," জ্বি দিয়েছি, মেয়েটা একটা বিপদে পড়েছিলো, তাই আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি।"
অফিসার বললো," কি ধরনের বিপদ ছিলো?"
ফাহমিম চৈতীর পুরো ঘটনাটা খুলে বললো।
পুরো ঘটনাটা শুনে অফিসার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, "দেখুন ফাহমিম সাহেব, হয় আপনি মিথ্যে বলছেন, নয়তো চৈতী আপনাকে মিথ্যে বলেছে।"
ফাহমিম বললো, "কি বলছেন এই সব, আমি কেন মিথ্যা বলতে যাব, তাছাড়া চৈতিই বা মিথ্যে কেন বলবে?"
অফিসার কিছু না বলে ওয়ারেন্ট ওর্ডারের কাগজটা দিলো ফাহমিমকে, কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে ফাহমিম কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে বললো, "এটা হতেই পারে না।"
অফিসার আগের মতোই হেসে বললো, "এটাই সত্য, চৈতী নামে আপনি যাকে আশ্রয় দিয়েছেন সে একটা বিরাট স্মাগলিং গ্রুপের সদস্য, আমরা গত ছয় মাস ধরে তাকে হন্য হয়ে খুঁজছি, তার কাছে গ্রুপটার অনেক তথ্য আছে।মাস তিনেক আগে আমরা প্রায় তাকে ধরেই ফেলেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধরতে পারিনি, সে এদিকে কোথাও এসে লুকিয়ে পড়ে, এতোদিন অনেক চেষ্টা তদবিরের পর আমরা সন্তোষজনক পরিমাণ তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হতে পারি যে সেদিন আপনিই তাকে আপনার বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। আমরা আপনার ব্যাপারেও তলিয়ে দেখবো। আমরা সন্দেহ করছি আপনিও সেই স্মাগলিং গ্রপটার সাথে জড়িত। কাজেই আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং সে জন্য আপনাকে এখন আমাদের সাথে ডিবি অফিসে যেতে হবে।"
একটানে কথাগুলো বলে থামলো অফিসার। ফাহমিম প্রচন্ড ঘামতে শুরু করেছে। ফাহমিমের মনে হচ্ছে সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। দুঃস্বপ্নও এতো অপ্রত্যাশিত হয় কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহ হতে শুরু হলো তার। কথাগুলোর শোনার মুহুর্তের মধ্যেই যেন প্রবল কম্পনে দুলতে আরম্ভ করলো ফাহমিমের সমস্ত পৃথিবী
...............................................................................(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০০৮ রাত ১১:০৫