আগের মত আমি এখন আর ব্লগে পড়ে থাকি না, দিনে দুই একবার এসে চোখ বুলাই। কারণটা যতটা আলসেমি, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী ইদানিংকালে এখানকার অত্যন্ত নিম্নমানের সাবজেক্ট এবং লেখার আধিক্য। তবে দিন দুয়েক আগে চোখ বুলাতে গিয়েই কয়েকদিন ধরে জাফর ইকবাল স্যারকে নিয়ে যে নোংরামি শুরু হয়েছে সেটা নজরে পড়ল। আর এই নোংরামির মাত্রাটা দেখে মনে হলো এর বিরুদ্ধে যদি কিছু না বলি সেটা এই দেশের জন্য যারা গত ৪০ বছর ধরে বহু ত্যাগ স্বীকার করছেন তাদের প্রতি একটা চরম বেইমানি হবে।
বেশ আগে কোথায় যেন কথাটা শুনেছিলাম “একটা দেশের লেখকসমাজ হচ্ছেন সে দেশের আত্মার মতো।” আমাদের দেশে ভুঁইফোঁড় কবি-সাহিত্যিকের অভাব নেই, যেটার অভাব আছে সেটা হচ্ছে চিন্তাশীল, মেধাবী, এবং দেশের জন্য ভালবাসা আছে এমন বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর। ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল এই রেয়ার বাংলাদেশীদের মধ্যে একদম প্রথম সারিতে থাকবেন এমন একজন মানুষ, শিক্ষক, লেখক, গবেষক। এদেশের সবচেয়ে দুঃখজনক দিকটা হচ্ছে আমাদের টোটাল সিস্টেমটা ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে সেট করা যে দেশের সবচেয়ে ট্যালেন্টেড এবং মুল্যবান ছেলেমেয়েগুলার সবচেয়ে বড় অংশটা নিজেদের যথাযোগ্য পারিশ্রমিক এবং সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে অবধারিতভাবে বিদেশে পাড়ি জমায়; এবং এদেশে দাপটে রাজত্ব করে ফালতু, বস্তাপচা বাতিল মালগুলা। এর বাইরেও কিছু হতভাগ্য নিরুপায় মানুষ আছেন যারা এই দেশের ওপর এবং এই দেশের সিস্টেমের ওপর ত্যাতঃবিরক্ত হয়ে ডেস্পারেটলি বিদেশে চলে যেতে চাচ্ছেন, কিন্তু বিভিন্ন কারনে পারছেন না। মেধাবী শ্রেণীর মানুসগুলার মধ্যে খুব কমই আছেন যারা বিদেশের ডলার-ইউরো, আরাম আয়েশের মায়া কাটিয়ে দেশের টানে, দেশের জন্য কাজ করতে বউ-বাচ্চা সহ ফিরে আসেন। এই কাজ করতে হলে দেশপ্রেম থাকতে হয়, বাঘের বাচ্চা হতে হয়, চরম ত্যাগ স্বীকার করার মানসিক প্রস্ততি লাগে; এবং এইমাত্র যাদের কথা বললাম, সেই বউ-বাচ্চাদেরও চরম কম্প্রোমাইসিং মেন্টালিটি থাকতে হয়। আমার বহু নিকটাত্মীয় পারেন নি। আমি নিজেও এত বড় স্যাক্রিফাইস করতে পারতাম না, পারবোও না। তাই যারা পারেন, তাদের আমি সবসময়ই স্যালুট জানাবো।
এই দেশের জন্য আমার যতটুকু টান আছে, মায়া আছে; তার একটা বড় অংশ গড়ে উঠেছে ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল (এবং তার বড় ভাই হুমায়ুন আহমেদ) এর বিভিন্ন লেখার প্রভাবে। আমার জেনারেশনের বহু ছেলেমেয়ের মতো আমারও শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে উনার লেখা পড়ে। মানুষ হিসাবে আমি যা, তার পেছনে উনার ইনডিরেক্ট যে অবদানটা আছে সেটা আমি কখনোই অস্বীকার করতে পারবো না। ৭১-পরবর্তী মানুষের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যে ভালোবাসা; স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি যে বিতৃষ্ণামূলক ঘৃণা সেটারও একটা বড় অংশ উনারই গড়ে দেয়া। এদেশ কি সেটা অস্বীকার করতে পারবে?
দেশের ছোট একটা শ্রেণীর ডক্টর জাফর ইকবাল-বিদ্বেষের ঠিক এটাই কারন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্বাভাবিক নিয়মে বাঙ্গালি ৭১ সালে এদের কার্যকলাপ ধীরে ধীরে ভুলে যাবে, দেশের মূলধারার সাথে মিশে যাবে এই শ্রেণীটার এই আশাকে চল্লিশ বছর ধরে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছেন জাহানারা ইমাম, শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, তারেক মাসুদ, ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলা। আমি শিওর; কোন কিছু পাওয়ার আশায় না, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন রাজনীতিবিদরা ইতিহাস বিকৃতির বলি বানাতে না পারে শুধুমাত্র সেই কারনে। কাজেই উনারা যাদের বিরুদ্ধে অলিখিত যুদ্ধ করে চলেছেন এখনও, সেই বাংলাদেশের শত্রুরা উনাদের চরিত্র লঙ্ঘনের বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলেই লাফিয়ে উঠবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
শেষের কথাটা ডক্টর জাফর ইকবালকে উদ্দেশ্য করে বলবো: এদেশে ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা আপনাকে ঘৃণা করে। তবে এরা টোটাল পপুলেশনের ১% ও না। ৯৯%+ মানুষ ডিরেক্টলি বা ইনডিরেক্টলি আপনাদেরই দেখানো রাস্তাতে চলছে। এখনকার শিক্ষিত যুবসমাজের মানসিকতা গড়ে তোলাতে আপনার কনট্রিবিউশন অসামান্য, এর কৃতজ্ঞতা ভাষায় বোঝানোর না। আপনাকে রিকোয়েস্ট: ফালতু এবং নোংরা কিছু লোকের কথায় দেশের বাকি মানুষের ওপর অভিমান করে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন না। আপনারা চলে গেলে এদেশটার আর বলার মত কিছুই থাকবে না। আমাদের কাছে কিন্তু আপনি সবসময় একজন সুপারহিরো হয়েই আছেন! এবং সবসময় থাকবেনও তাই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



