-------------------------------------
(১)
আমি কলেজ থেকেই একটু আধটু কবিতা লিখি। লিখি না বলে হয়তো লেখার চেষ্টা করি বলাই ভালো। কারণ যা লিখেছি সেগুলো পরে নিজের কাছেই আর তেমন ভালো লাগেনা। তাই মনে মনে নিজেকে 'কবি' দাবী করলেও প্রকাশ্যে অন্য কারো কাছে সে দাবী কখনোই করিনা। একে অন্তর্মুখিতা বলতে পারেন অথবা অযোগ্যতা, কেউ কেউ সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখলে একে বিনয় বলেও ভাবতে পারেন। এই যে নিজেকে 'কবি' দাবী করতে না চাওয়া তার পেছনে একটা শঙ্কা কাজ করে। যে দেশে মাইকেল, রবি ঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ সহ পঞ্চ পান্ডব, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকের অনেক খ্যাতনামা কবি বাংলা কবিতার ঝান্ডাবাহী সেখানে নিজেকে কবি বললে মনে হয় আমি তাঁদের সমকক্ষ হবার দৃষ্টতা দেখাচ্ছি। কিংবা সেরকম যোগ্যতা, পরিশ্রম না থাকা স্বত্বেও এমন ভাব করছি যেন তাঁদের কাছাকাছি চলে গেছি। নিজেকে কবি বলতে এই দ্বিধা থাকলেও নিজের লেখাগুলোকে আড়াল করে রাখিনা কখনো। চাই যেন সবাই এই অধমের লেখা পড়ে। প্রশংসা করলে খুশি হই, কিন্তু অনেক বেশি খুশি হই কেউ সমালোচনা করলে। ( গালি না, গালি আর সমালোচনার পার্থক্য বাঙালি বোঝেনা, একজন বাঙালি হিসেবে আমিও বুঝিনা অনেক সময়)। ভালো , যুক্তিযুক্ত সমালোচনা এবং নিয়ন্ত্রিত প্রশংসা একজন নতুন লেখকের জন্য পদস্খলন থেকে বাঁচার উপায়।
(২)
'কবি' বলে নিজেকে দাবী করিনা এর মানে কি এই যে আমার লেখা একদমই ভালো হয় না? যদিও আমার খুব বেশি ভালো হয় সে দাবী আমি করবোনা, কিন্তু একেবারে খারাপ হয় এই দাবী কেউ করলে আমি সরাসরি অগ্রাহ্য করবো। মাঝে মাঝে এমন সব থিম, শব্দ, পঙক্তি লিখে ফেলি যে পরবর্তীতে পড়ে মনেই হয়না সেগুলো আমি লিখেছি! একেই বুঝি রবি ঠাকুর জীবনদেবতা বলেছেন, মাইকেলের দেবী কূললক্ষ্মী ।
“I don’t worry about the status of poetry as an art form. Good poems find their way in the world and they stand the test of time.” — Wendy Cope ( a british poet )
নিজে যা লিখি তা নিজের ভালোলাগা থেকেই, নিজের জন্যই। কখনো তা ভালোবাসার প্রকাশ, কখনো তা প্রতিশোধ গ্রহণের হিরন্ময় হাতিয়ার। তারপরও যারা পড়েন, প্রশংসা ও সমালোচনা করেন তাঁদের জন্যই আমার নিতান্ত বাচ্চামো ধরণের অপরিপক্ক লেখাগুলো কিছুটা পরিনত হয়েছে, যদিও জানি এই যাত্রার শেষ নেই কোন। এই সামগ্রিক পথচলায় কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, ভেবেছি, উত্তর খুঁজেছি। কবিতার সঙ্গে আমার জীবনযাপন নিয়ে নিজেই নিজের ভেতর মূল্যায়ন করেছি। কখনো হতাশ, কখনোবা ভীষণ ভালোলাগায় জড়ানো আমার কবিতারা। এখানে আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর দিবো, কিছু তির্যক মন্তব্য এবং আমি মুখোমুখি হয়েছি এমন কিছু ভুল ধারণা নিয়ে কিছু কথা বলবো। হয়তো অনেকগুলো কথাই ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, তা যাক। তাতে কিছু আসে যায় না। কবিতা যে লেখে সে-ই কবিতা নিয়ে আলাপের মুখ্য দাবিদার, বাকি অনেকেই আছেন কিন্তু দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সাড়িতে।
(৩)
প্রথমত, এখনকার যারা কবিতা লেখেন তাঁদের কাছে অনেকেরই অভিযোগ তাঁরা কেন ছন্দে লেখেন না। ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় নাকি! অন্য যারা লেখেন তাঁদের কথা জানিনা। নিজের কথা বলতে পারি, ছন্দ পারিনা, শেখার আগ্রহ আছে পরিশ্রমের ভয়ে পারিনা শিখতে। তাই সব লেখা গদ্যেই লিখি। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা অন্ত্যমিলকেই ছন্দ ভেবে বসে থাকেন, তারা অনেকের বিরুদ্ধেই ছন্দহীনতার অভিযোগ আরোপ করেন।
আচ্ছা, গদ্যে লেখাও তো একরকম ছন্দ্যে লেখা? তাই না? নাহলে 'গদ্য ছন্দ' কেউ বলতোনা নিশ্চই! রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের একটা কাব্যগ্রন্থ (সম্ভবত - ঐকতান) গদ্যে লেখা হয়েছিলো। এটা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের উপর তিরিশের দশকের কবিদের একটা প্রভাব হিসেবেই দেখা হয়। তাহলে রবীন্দ্রনাথকেও আপনাদের অজ্ঞতার ছুড়িতে ফালাফালা করুন? না, তা তো আর পারবেন না। বিশ্বকবি বলে যাকে দিনরাত পূজা করেন তাকে নিয়ে তো চাইলেই কিছু বলা যায়না! আর বললে সবাই মনে করবে আপনি পাকামো করছেন।
(৪)
দ্বিতীয় যে অভিযোগ সেটা হল দুর্বোধ্যতা। সবারই এক কথা 'কবিতা লিখছো, পড়ে ভালোই লেগেছে কিন্তু কিচ্ছু তো বুঝিনি! '
সকলেই কবিতা বুঝতে চায়, তা ভালো লাগুল কি না লাগুক। অবশ্য এই যুগে ভালো না লাগলে কেউ জিজ্ঞেস করেননা এসব। ভালো যাদের লাগে তারাই বলেন। এটা হয়তো আমাদের দেশে কবিতা পড়ানোর ব্যাবস্থার দোষ। (*সে দোষ নিয়ে বললে বিস্তর বলা লাগবে, সেসব অন্য কোথাও বলবো।)
যারা এই শিক্ষাব্যবস্থার অসুবিধার জন্য কবিতা/শিল্পের প্রতি ভয়, অবহেলা নিয়ে বড় হন তাদের সমস্যাটা বুঝি। সেটা আমার আলাপের বিষয়ওনা। অনেকেই তো আছেন যারা পড়েন, শোনেন, দেখেন এবং বোঝেন। ভাবে শিল্পবোদ্ধা, কিংবা ভাব না নিলেও আসলেই আর্ট বোঝেন এবস্ট্রাক্ট (*) আর্টে রঙের অর্থহীন খেলা দেখে আনন্দ বোধ করেন তাদেরই বা না বোঝার কী কারণ থাকতে পারে?
এরকম কয়েকজন আর্টবোদ্ধা লোকজনরেও এসব কবিতা নিয়ে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ করতে দেখেছি। আমি হয়তো তেমন ভালো লিখিনা কিংবা লেখা সেরকম শিল্পমানের হয়ে ওঠেনা কখনো, তাই তাদের দুর্বোধ্য লাগে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে তারা আর্ট এক্সিবিশনে গিয়েও কি আর্টিস্টকে তার আর্টের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন করেন?
" এইযে আর্টিস্ট সাহেব, এইযে সাদার পাশে কালো গোল্লা দিয়ে আপনি কি বোঝালেন? রেসিজম? "
কিংবা "এইসব কী হিজিবিজি রঙের আঁকিবুঁকি! বুঝিনাতো কিচ্ছুই!"
এসব বলেন? অবশ্যই না! কারণ এই চিত্রকর্ম দেখে তাদের ভালো লাগা নিয়ে নিজেরাই নিজের মত করে বোঝে নেন। প্রশ্ন করলেই গোল বাধবে।
তাহলে আর্টবোদ্ধা হয়ে তারা কি একজন কবিকে দুর্বোধ্যতার জন্য অভিযুক্ত করতে পারেন? পারেননা। শিল্প বুঝলে তিনি কবিতাও বুঝবেন, আধুনিক দুর্বোধ্য সিলওয়ালা কবিতাও। শিল্পীকে তার আর্টের অর্থ, দুর্বোধ্যতা নিয়ে কটুক্তি করা, প্রশ্ন করা যেমন অনুচিত তেমনি কবিকেও তাঁর কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে অযাচিত প্রশ্ন করা অনুচিত।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২৩