নাজিম হিকমতের ২টি কবিতা
(ইংরেজি থেকে অনুবাদ - মো: রেজাউল করিম)
১। স্বাধীনতার বিষণ্ণ রূপ
.
তোমার চোখের মনযোগ তুমি নষ্ট করেছো
নষ্ট করেছো দুই হাতের চমকপ্রদ শ্রম ।
তুমি কয়েক ডজন রুটির উপযোগী ময়দা করছো মন্থন,
যে রুটির একটি গ্রাসও তুমি ভোগ করবেনা;
তুমি অন্যদের দাস হবার ব্যাপারে স্বাধীন
তুমি ধনীদের আরো বেশি ধনী করার ব্যাপারই স্বাধীন।
.
তোমার জন্মমুহূর্তে ওরা তোমার চারপাশে স্থাপন করলো
মিথ্যা উৎপাদনের কারখানা;
মিথ্যা - যা আজীবনের জন্য যথেষ্ট।
তুমি চিন্তাশীল ভঙ্গীতে তোমার মহান স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তা করেই যাচ্ছো !
স্বাধীন চেতনাটুকু থাকার স্বাধীনতাই কেবল তোমার আছে।
.
তোমার মাথা এতই নত যেন
তা গ্রীবা থেকে অর্ধেক কাটা
তোমার হাতদুটো লম্বা, ঝুলানো
মহান স্বাধীনতা নিয়ে তুমি উদ্দেশ্যহীন
এবং স্বাধীন,
বেকার থাকার স্বাধীনতা নিয়েই,
তুমি স্বাধীন।
.
তোমার জানা সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুর মতই
তুমি ভালোবাসো স্বদেশকে।
অথচ একদিন,
ধরো তারা একে আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করতে পারে, এবং তোমার মহান স্বাধীনতাসহ তোমাকেও
তোমার প্রিয়তম দেশের একটি বিমানঘাটি হবার স্বাধীনতাটুকুই আছে।
.
তুমি হয়তো দাবী করো মানুষ কখনো মানুষ ছাড়া যন্ত্র ,সংখ্যা কিংবা শুধুই একটি যোগসূত্র হিসেবে থাকতে পারেনা,
তখন হঠাৎ তারা তোমার হাতে পরালো হাতকড়া
তুমি গ্রেফতার হবার জন্যই স্বাধীন,
কারারুদ্ধ হবার জন্য স্বাধীন
ফাসিতে ঝুলে মৃত্যুর জন্য স্বাধীন।
.
লোহার কাঠের কিংবা সূক্ষ্ণ রেশমের পরদাও তোমার জীবনে নেই
স্বাধীনতা চেয়ে নেবার দরকার নেই
তুমি স্বাধীন,
কিন্তু এই ধরনের স্বাধীনতা অনন্ত নক্ষত্রবীথির নিচে
একটি ব্যর্থ প্রেম ছাড়া আর কিছুনা।
.
.
২। আশাবাদী মানুষ
.
শৈশবে সে কখনো মাছির পাখা ছেড়েনি
বিড়ালের লেজে বাধেনি টিনের ক্যান
ম্যাচবাক্সে বন্দী করেনি পোকাদের
কিংবা আটকে রাখেনি উইপোকাদের ।
সে বড় হয়ে উঠলো,
এইসব কিছুই করা হল তার প্রতি
আমি তার মৃত্যুশয্যার পাশেই ছিলাম ।
সে সমুদ্র ও সূর্য নিয়ে,
পারমাণবিক চুল্লি ও স্যাটেলাইট নিয়ে
মানব সভ্যতার মহত্ব নিয়ে
আমাকে একটা কবিতা পাঠ করতে বললো।
** ( নাজিম হিকমত (১৯০২-১৯৬৩)
নাজিম হিকমত একজন তুর্কি কবি। জন্ম তুরষ্কে হলেও ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পরে জীবনের বিরাট একটা অংশ কেটেছে অন্য দেশে। মস্কোতে কেটেছে তার অধিকাংশ জীবন। সেখানে রাশিয়ান কবি মায়াকোভস্কির সাথে পরিচয় হয়েছে। দুইজনেই ছিলেন বামপন্থী আদর্শে উজ্জীবিত। মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাধীন তুরস্ক থেকে রাশিয়ায় চলে যান। ১৯২৪ সালে তুরষ্কের স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু বামপন্থী একটি পত্রিকায় কাজ করার অপরাধে অচিরেই গ্রেফতার হন। পরে মস্কোতে পালিয়ে যান।
১৯২৮ সালে পুনরায় তুরষ্কে আসার অনুমতি পান। পরবর্তী ১০ বছরে তিনি সাংবাদিক, অনুবাদক হিসেবে কাজ করাকালীন প্রকাশ করেন ৯ টি কবিতার বই। এরপর পুনরায় দীর্ঘ কারাবাসের পর ১৯৫১ সালে শেষবারের মত তুরষ্ক ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। এবং কমিউনিজমের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। এসময় রাশিয়ান ফিউচারিস্টদের প্রভাবে এসে কবিতার গতানুগতিক ফর্ম পরিত্যাগ করেন। অবশ্য ইতোমধ্যেই প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৬৩ সালে হার্ট এটাকে মৃত্যুবরণ করেন। নাজিম হিকমত বিংশ শতাব্দীর অন্যতম একজন আন্তর্জাতিক কবি হিসেবে স্বীকৃত। জেলখানার চিঠি কবিতাতে লিখেছেন, "মানুষের মুন্ডুটাতো আর বোটার ফুল নয় যে ইচ্ছে হলেই টান দিয়ে ছিড়ে নেবে!" কী অসাধারণ!
তার প্রতিবাদী কবিতাগুলো মুক্তিকামী, মাটির কাছাকাছি মানুষের কাছে চিরদিন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।)
.
*পুনশ্চ - শহরতলী ব্যান্ডের 'জেলখানার চিঠি' শুনতে পারেন। নাজিম হিকমতের কবিতার বারুদের গন্ধ পাবেন বেশ ভালোমতই !
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৫৫