ভোরে ঘুম থেকে উঠে মকতবে যেতাম। যাদের নামাজ পড়ার অভ্যাস ছিলো তারা আদায় করতো। অন্যরা অজু করেই মকতবে চলে আসতো। যারা প্রশ্রাবের পর পানি ব্যবহার করতো না তারা কোমর পর্যন্ত ধোয়ে নিতো কেনানা এক্ষেত্রে হুজুরের সতর্কতা ছিলো, পানি ব্যবহার না করলে কিংবা কোমর পর্যন্ত না ধোলে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো। এখনতো ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোয়ে সকালের নাস্তা করে। আমাদের সময় তেমন ছিলো না। ১/২ বেলা বিস্কুট কিংবা দু মুটো মুড়ি পকেট কিংবা কাপড়ের কোণায় নিয়ে খেতে খেতে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে মকতবে চলে আসতাম। শীতকালে মাঝে মাঝে বিস্কুট/মুড়ির পরিবর্তে পেতাম সিদ্ধ আলু।
মকতবে মাথা সম উঁচু স্থানে কোরআন রাখার তাক ছিলো।যারা কোরআন পড়তো তাদের তাক ছিলো উপরে, আর যারা কায়দা পড়তো তাদের তাক ছিলো অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানে। মকতবে প্রবেশ করে হুজুরকে সালাম দিয়ে তাক থেকে কোরআন / কায়দা নিয়ে নিজ নিজ স্থানে বসে যেতাম।। হুজুর একে একে সবাইকে সবক (পড়া বাতলিয়ে দেয়া) দিতো। সবক দেয়ার পর, হুজুর মকতবের এই প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বেত নিয়ে হাঁটতো, আমরা উচ্চস্বরে পড়তাম। কেউ কথা বললে কিংবা অমনযোগী হলে অমনি পিঠে বেতের বাড়ি! সবক আদায় হলে হুজুরকে সবক দিয়ে, নতুন সবক নিতাম। আর না পাড়লে পুনঃরায় বাতলিয়ে নিতাম। আমাদের মকতবের পড়া অনেক দূর থেকেও শোনা যেতো। সবার পড়া শেষ হলে, ১৫-৩০ মিনিট মাসালা মাসায়েল শিখানো হতো। কালেমা ,নামাজ, রোজা,মৃত ব্যক্তির গোসল,কাফনের কাপড় পড়ানো, দাপন করার নিয়ম এসব বিষয়ের কুটি নাটি সব দেখিয়ে দেয়া হতো। এখনতো উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীকে পাঁচ কালেমা জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করে। কেউ মারা গেলে হুজুরের সরনাপন্ন হতে হয় গোসল দেয়ানোর জন্য,কাপন পড়ানোর জন্য লোক খোঁজতে হয়, দাফন করানোর জন্য মানুষ ভাড়া করে আনতে হয়। অথচ এই সব বিষয় তখন মকতবেই শিক্ষা দেয়া হতো।
হুজুর শিখিয়ে দেয়ার পর কেউ একজন উচ্চ আওয়াজে বলতো, আমরা সবাই উচ্চস্বরে মুখে মুখে পড়তাম। বিষুদবার সকলের মনে খুশি থাকতো কেননা সেদিন কোরআন/কায়দা পড়ানো হতো না। পুরো সপ্তাহে যে মাসায়ালা শিখানো হয়েছে তার প্রেক্টিক্যাল ক্লাস হতো।
একজনে নামাজ পড়াতো, হুজুর তা দেখতেন ঠিকভাবে আদায় হচ্ছে কিনা ! ভুল হলে শোধরিয়ে দিতেন। আমাদের মকতবে উপরে ফ্যান ছিলো না, নিচে টাইলস বিছানো ছিলো না। প্রকৃতির আলোতে নিচে ছাটাই বিছিয়ে ছোট ছোট রেহাল/ব্যাঞ্চ এর উপর কোরআন/কায়দা রেখে বেশ মজা করেই পড়েছি।
আজো সে পড়া মনে আছে। মকতবের কেউ যেদিন কায়দা শেষ করে কোরআনের সবক নিতো সেদিন আনন্দে সবাইকে চনাচুর আর মুড়ি খাওয়ানো হতো।ছুটির সময় সবাই লাইন ধরে দাড়াতো, ছেলেরা টুপিতে আর মেয়েরা আঁচলে নিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতো। যাদের সামর্থ ছিলো জিলাপী অথবা খেজুর খাওয়াতো। এসবে দিব্যি চলেছে আমাদের। সে মকতব এখন হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ইসলামের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র।
[ছবিগুলো গুগলের সাহায্যে পাওয়া]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৮ সকাল ১০:৫৮