somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গার্মিশে ঘ্যাও ম্যাও-৩

২৫ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৩:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পর্ব ১
পর্ব ২
৩.
দুইয়ের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে তিন নম্বর দিন চলে এল। শহুরে যান্ত্রিকতা আমাদের গেলার অপেক্ষায় হাঁ করে পথ চেয়ে বসে আছে। দুপুরে ফেরত যাব। ঘোরাঘুরির জন্যে হাতে সময় কম। অল্প সময়কে টেনে চুইংগামের মত লম্বার করার ধান্দায় গতি কমিয়ে শামুক হয়ে গিয়েছি। এই মুহূর্তে জুতার তলি ঘষটে ঘষটে বিরক্তিকর শব্দ তুলে গা ছেড়ে হাঁটছি। কাছেপিঠে বেঞ্চি দেখলে মোক্ষম একটা গড়ানিও দিয়ে ফেলতে পারি।

পার্কটা বিশাল। গার্মিশের একেবারে পেটের ভেতর। সবুজে ঘেরা এক ভিন্ন সমান্তরাল জগত। কে বলবে বেড়ার ওপাশেই চক্কর বক্কর হাওয়াই শার্ট পড়া পর্যটকের ভিড়ভাট্টা। দূরে বসার একটা জায়গা দেখলাম। কিন্তু বাঁধ সেধেছে তাফসু মিয়া। অভিভূতের মত লাল সাদা গোল্ডফিশের মিছিল দেখছে গোল পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরটা গোলও না, পুকুরও না। আয়তাকার ছোট্ট পুল। কিন্তু গোল পুকুর বলতে ভাল লাগে কেন যেন।
ছেলেকে তার বাবার জিম্মায় রেখে বসার জায়গা বরাবর এগোলাম। মাঝারি আকারের পুরানো এ্যাম্ফিথিয়েটার। এই পোড়ো এ্যাম্ফিথিয়েটারে বাস করে মমো নামের অদ্ভূত ছোট্ট মেয়ে। শতেক তালির মলিন জামা পড়ে সে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় । কেউ জানে না কোথায় তার বাবা-মা। তার সঙ্গী শুধু কাসিওপিয়া নামের এক কাছিম। মিখাইল-এন্ডে কুরপার্ক নামের এই পার্কটা আসলে জার্মান লেখক মিখাইল-এন্ডে’র বিখ্যাত বই ‘মমো’র আদলে সাজানো। এ্যাম্ফিথিয়েটার ছেড়ে দুই পা হাঁটতেই দেখি কাসিওপিয়া নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু শান্ত কচ্ছপটার শান্তি বরবাদ করে দিল আমাদের ছানাপোনা। একজন কংক্রিট নাক ধরে যথেচ্ছা দোল খেল। আরেকজন তার পিঠে সওয়ার হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালালো।

মমো’র গল্পটা অল্প করে বলেই ফেলি। হঠাৎ শহরে ভিন জগতের একদল ধূসর মানব এসে বলে, ‘এ্যাই বেয়াক্কেল মানুষ, তোমরা দেখি গড়িয়ে, ঘুমিয়ে আর আড্ডা দিয়ে প্রচুর সময় নষ্ট কর। তার চেয়ে আমাদের এই নতুন ব্যাংকে সময় জমা দিয়ে যাও না। সুদে-আসলে ফেরত পাবে।‘ সুদের লোভে লোকে আসল সময়টুকু জমা দিয়ে আসল। অলস সময় নেই কারো হাতে। কিন্তু জীবন হয়ে গেল গল্প-আড্ডা-ঘুমহীন ম্যারম্যারে, একঘেয়ে। তখন মমো ধূসর মানবের সাথে লড়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সময়-ব্যাঙ্কের কুঠুরি ভেঙ্গে ফেলে। সবাই চুরি যাওয়া সময় ফিরে পায়। তাদের শুষ্কং কাষ্ঠং জীবন আবার গল্প-আড্ডায় প্রানবন্ত হয়ে ওঠে।
মমোর গল্পটা নূরের বই পোকা বাবা আমাদের হাদি ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। তাফসুর বাবাকে বলতে গেলাম, ‘এ জন্যেই তো আমি গড়িয়ে চলি, অলস ঘুমিয়ে থাকি, অনর্থক আড্ডা দেই। সময় নষ্ট করাটাও জরুরী, বুঝলেন?’ বেখাপ্পা উত্তর আসল, ‘ফিরে গিয়ে বাজারের লিস্টে ডিম লিখতে হবে কিন্তু। ঘরে মাত্র দুইটা ডিম।‘ বেড়াতে এসেও নিউরনে বাজারের চিন্তা! হতাশ কাঁধ ঝুলিয়ে ক্যাসিওপিয়ার পিঠ থেকে ছেলেকে নামাতে গেলাম। এই ছেলে মায়ের মত হয়েছে। আগোছালো, উদাস আর হাবাগোবা। তবে বলা যায় না, কোন অতি সাংসারিক বাঙালি কালোকেশী কি জার্মান স্বর্ণকেশীর পাল্লায় পড়ে তাকেও অদূর ভবিষত্যে বাজারের লিস্টে আধ ডজন ডিম যোগ করতে হতে পারে। সবই তকদির!

সবুজ ফেলে শহরের ভিড়ে ঢুঁকে পড়েছি আবার। অল্প বয়সীরা হয় তুমুল কেনাকাটায় ব্যস্ত, নয় ছবি তুলতে মগ্ন। বুড়োরা কৌতূহলী চোখে তা-ই দেখছে ছড়ানো ছিটানো রেস্তোরাগুলোতে আসন গেঁড়ে বসে। তাদের টেবিলে স্বাস্থ্যকর সালাদের বাটি আর অস্বাস্থ্যকর বিয়ারের বোতল কিংবা ধূমায়িত দামী সিগারেট। আরো সৌখিন হলে হাভানা চুরুট। বিয়ার-বিড়ির প্রতি ভালবাসা না থাকলেও সময় নষ্ট করার এই জাঁকালো আয়োজন দেখতে বেশ লাগছে।
এরকম চমৎকার জায়গায় হারিয়ে গেলে মন্দ হত না। তবে হারানোর পাঁয়তারা না করাই ভাল। তখন দেখা যাবে পারিবারিক চাকরিটা থেকে ছেলের বাবা আমাকে ছাটাই করে দিয়েছে। একটু আগে তার মাথার ভেতর ঢুকেছিলাম। দেখি সে খুব বিরক্তি নিয়ে কম্পিউটারের ওয়ার্ড, এক্সেল ফাইলের undo বোতামের মত একটা বোতাম খুঁজছে। এই বোতামে চেপে সে কাউকে মুছে দিতে চায়। গজগজও শোনা গেল। কেই একজন নাকি তার কলিজা চিবিয়ে খাচ্ছে। গত সপ্তাহে দামী হেডফোন হারিয়েছে, এ সপ্তহে ভালো ছাতাটা। এখানে এসে প্রথম দিনেই দশ ইউরোর টিকেটও। এই চিজ নিয়ে কিভাবে সংসার চলে!‘ এইখানে গরম কান নিয়ে আস্তে করে তার মাথা থেকে বেরিয়ে এলাম। অভিযোগ সব ক’টাই সত্য। তবে ছেলে হারিয়ে ফেলি নি যে এ পর্যন্ত, এটাই বড় কথা। (চলবে)


সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৩:১৭
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×