৩.
পথটা নেহাৎ কম না। একঘেয়েমি লাগছে না যদিও। পথের ধারে বাহারি বাড়িগুলো দেখার মত। এগুলো ছোট ছোট গেস্টহাউস। কাঠের দেয়ালগুলোতে হোটেল হোটেল কমার্শিয়াল গন্ধ নেই। তার বদলে আছে বারান্দা উপচে পড়া ফুলের সুবাস। ফুলের থোকাগুলো যেন বাড়ির মালিকের রুচির সার্টিফিকেট হয়ে ঝুলে আছে ব্যালকনির ফোঁকর গলে। কোথাও বারান্দার এধার থেকে ওধার জুড়ে শুধুই রক্ত লাল গোলাপ। কোনো বা বাড়ির ফুল হালকা গোলাপি থেকে গাঢ় হতে হতে বেগুনি বনে গিয়ে একেবারে লতিয়ে সদর দরজায়ে নেমে এসেছে। এমন জায়গায় দিন দুই কাটালে জব্বর হতো।
উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তায় এখন রীতিমত হাঁপ ধরে যাচ্ছে। আরেকটু এগোলেই নাকি পৌঁছে যাব। মৌরি আপুর মন ভুলানো কথাও হতে পারে। তাও সরল মনে পা চালিয়ে যাচ্ছি। খানিক বাদেই বামের অদ্ভূত পথটা দেখে থামতে হলো। ঢালু হয়ে কই যে নেমে গেছে, বোঝার উপায় নেই। দু’পাশে নেই বাড়িঘর, নেই গাড়িঘোড়া। শুধু গাছগাছালি। সবুজ ডিঙ্গিয়ে চোখ চলে যায় দূরের পাহাড়চূড়ার মরীচিকায়। যেন হাত বাড়ালেই নাগাল মিলবে। কোত্থেকে হঠাৎ এক বুনো বাদামী খরগোশ লাফিয়ে উঠে মিলিয়ে গেল। কৌতূহলে এগিয়ে গেলাম এক পা। যাবো নাকি এই পথে? হারিয়ে যাবার হাতছানিটা মায়াবী সুরে ডাকছে ‘আয় আয়’। ওদিকে বাকিরাও ডাকছে খুব। নাহ্, হাতছানিটা ফিরিয়ে দিতে হল। খরগোশের পিছু ছোটা আর হল না।
কাঠের সাঁকো এঁকেবেঁকে চলে গেছে লেকের পাড় ঘেঁষে। ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে চলছি। স্বচ্ছ জলে এক আধটা মাছ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। মনের ভেতরের বড়শিটা টোপ লাগিয়ে তৈরি হতে চাইছে। ভাজা মাছের মচমচে ঘ্রান কল্পনা করে নিতে একটুও বেগ পেতে হল না। পানির বাতাস খিদে চাগিয়ে দিতে ওস্তাদ।
চারিদিকে শুধু পাহাড় আর পর্বত। তারই ঠিক মাঝখানে কাক চক্ষু জল টেগের্নসী। আকাশের আঙ্গিনায় ঘাসফুল মেঘ এখানে ওখানে ছন্নছাড়া ভবঘুরের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট ফেরি যাত্রী নিয়ে খুব ধীরে এগোচ্ছে। কারোই কোনো তাড়া নেই। তবে আজকে বাতাসের খুব তাড়া। জলে ঢেউ ভাঙ্গিয়ে ছাড়ছে সাগরের আদলে। উইন্ডসার্ফিং করতে আসা লোকজনের পোয়াবারো। বাতাস ফুড়ে উজ্জ্বল লাল-নীল পাল উড়িয়ে ছুটছে তারা। টেগের্নসী জায়গাটা আসলেই সুন্দর।
৪.
আলো ছায়া লুকোচুরি খেলছে, এমন জায়গা খুঁজে চাদর বিছিয়ে বসে পড়লাম। সাথে সাথে শক্তিশালী আলসেমিটা ছেঁকে ধরলো। মনে হল, বনবন্ না ঘুরে আজকের দিন শুয়ে বসে এখানেই গড়িয়ে দেই না। মাথার ওপর চড়া সূর্যটাও যেন সায় দিয়ে বললো, ‘চিল ম্যান, চিল। এই রোদ্দুরে ঘুরে কাজ নেই।‘ মাঝ দুপুরের রোদকে ‘কুল ডুড’ মেনে তার উপদেশ আমরা মাথা পেতে নিলাম।
জায়গাটা নিরিবিলি। যদিও লোকজন একেবারে কম না। পাশেই এক বিকিনি সুন্দরী ফিতাবিহীন পিঠ মেলে রোদ পোহাচ্ছে। তার হাতে মেলে ধরা কোনো পেপারব্যাক। এমন ভঙ্গিমায় পড়লে ছাইপাশ র্যান্ডম বইও পাঠক টানতে বাধ্য। ঘটছেও তাই। কতগুলো বছর আঠারো-বিশের ছেলে-ছোকরা কাছেই তাস পেটাচ্ছে আর অস্থির চোখ তুলে বইয়ের নাম পড়তে চাইছে। কি আর করা, বয়সটাই যে জ্ঞান আহরনের।
বাচ্চারা সাথে করে খেলার সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে। থলে উল্টাতেই ছোট বড় নানা কিসিমের ডাইনোসর বেড়িয়ে এল। সেগুলোকে ইচ্ছেমত চরতে দিয়ে তারা খড়কুটো জোগাড় করছে। উদ্দেশ্য, আগুন ধরিয়ে বন ফায়ারের আয়োজন। ফায়ারটা কোত্থেকে আসবে সেটা একটা ব্যাপার অবশ্য। দেখা গেল, আগুনের জন্যে পাশের ছোকরাগুলোর কাছে দেয়াশলাই চাইতে গিয়েছে। ওরা দিলো না, আর তাইতেই পাথর ছুড়ে মাথা ফাটিয়ে দিল। তখন তল্পিতল্পা তুলে ঝেড়ে দৌড় না দিয়ে উপায় থাকবে না আমাদের। (চলবে)