পর্ব ১ এখানে
২.
তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। ঢাকনি চাপানো লম্বা ট্রলিগুলো দেখে আর ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের ট্রলি ভেবে ভুল করি না। এই গাড়িতে চেপে হাসপাতাল-টু-মর্গ আর মর্গ-টু-প্রেয়ার রুমে চুপচাপ কাদের যাওয়া-আসা, সেটাও জেনে গেছি এতদিনে। মোট কথা, মোটা দাগের একটা নির্বিকার ভাব চলে এসেছে।
এক মাঝ দুপুরে সেই নির্বিকারত্ব জলে ভেসে গেল। সিড়ি ভাঙবো না বলে আলসেমি করে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চার তলায় কাজ আছে একটা। এমন সময়ে এক ভদ্রলোক পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন। ‘অমুক নম্বর রুমটা কোথায় বলতে পারেন?’ চট্ করে হাত চলে গেল ফোনে। ফ্রাউ ব্রাউনআইস কেস। ওপাশ থেকে জবাব এল, ‘রিসেপশনে বসতে বলবে একটু? এক্ষুনি আসছি। পাঁচ মিনিট, ওকে?’
একই কথা আবার তোতাপাখির মত আউড়ে লিফটের বোতাম চাপলাম। ভদ্রলোক বাধ্য ছেলের মত সোফার এক কোনে বসে পড়লো। বয়স চল্লিশ কি বেয়াল্লিশ। ছ’ফুটের ওপরে সুপুরুষ চেহারা। মাথা ঝুঁকিয়ে বসায় কোঁকড়ানো চুল কপাল বেয়ে নেমে পড়েছে। কোলের ওপর বাদামী লেদার ব্যাগ। কি ভেবে ব্যাগটার দিকে তাকালাম। যেনতেন ভাবে কাপড় ঠেসে জোর করে চেইন টেনে দিয়েছে কেউ যেন। অলক্ষ্যে এক টুকরো স্কার্ফ বেরিয়ে পড়েছে। তাতে বেগুনি রঙ্গে হালকা ফুলেল ছোপ।
‘আমার ওয়াইফের ব্যাগ। হাসপাতাল থেকে ফেরত দিল।‘ অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। কিন্তু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নামাতে গিয়ে জিজ্ঞাসা যেন আরো বেড়ে গেল। লোকটা বুঝতে পেরে বলেই চললো, ‘ওকেই আরেকবার দেখতে এসেছি।‘ এই দেখতে আসার কারন বুঝিয়ে বলতে হয় না আমাকে।
বেগুনি স্কার্ফ হাতের মুঠোয় উঠে এসেছে লোকটার। তাকে কূলহারা নিঃস্বের মত লাগছে। অস্ফুট একটা স্বরে চারপাশটা ভারি হয়ে উঠছে ক্রমশ। আশেপাশে লোকজন যে যার মত আসছে-যাচ্ছে; রুটিন কাজের ফাঁকে ডানে বামে ভ্রূক্ষেপ নেই কারো। শুধু আমিই যেন অচল দাঁড়িয়ে রইলাম। ফ্রাউ ব্রাউনআইসের পাঁচ মিনিট বুঝি আর ফুরোয় না।
৩.
সপ্তাহ খানেক হল এক তলার অফিসে ছেড়ে তিন তলার নতুন অফিসে ঠাঁই নিয়েছি। ভালই হয়েছে। কালো স্যুট-স্কার্ট পরা লোকজনের হানা থেকে বেঁচে গেছি। শুধু একটাই সমস্যা। হেলিকপ্টারের শব্দে কানে তালা লাগার যোগাড় হয় প্রায়ই। এই শব্দ মানেই কেউ একজন ভয়ানক অসুস্থ বা মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা। তাকে কোন দূর দূরান্ত থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছে হাসপাতালের ছাদে।
এইমাত্র কটকটে হলুদ রঙের আরেকটা হেলিকপ্টার নামছে। এই নিয়ে দিনের তিন নম্বর। জানালা বন্ধ করে হেন্ডফোন কানে লাগিয়ে বসলাম। একটা অনলাইন ক্লাস নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি অল্প কিছু দিন। নেশাটা রয়ে গেছে। কালেভদ্রে সুযোগ পেলে তাই ছাড়ি না। নানান বিভাগের পিএইচডি ছাত্রদের বাড়তি ক্রেডিটের ক্লাস। করোনাকালের এই নতুন স্বাভাবিকে ছাত্রদের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। তারপরও টানা দেড় ঘন্টা ডিজিটাল প্যাথলজির উপর বকবক করে সময় ভালই উড়িয়ে দেয়া গেল।
ক্লাস শেষে আমার মুক্তি মিললেও ছেলেমেয়েগুলো চারকোনা স্ক্রিনে বন্দী রয়ে গেল। একটা প্র্যাক্টিকাল আছে। ল্যাব ডেমোন্সট্রেশন। নিচের ডিসেকশন রুমের ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়। স্টেইনলেস স্টিলের ধাতব টেবিলে ফুটবলের মত কি যেন রাখা। কৌতূহল জাগলো। লাঞ্চে যাচ্ছিলাম। বাদ দিয়ে আবার বসে পড়লাম। ক্যান্টিনের অখাদ্য একদিন নাই বা খেলাম।
খিদে অবশ্য এমনিতেও মিটে গেল। নিউরো-প্যাথলজির ডক্টর ক্লেয়ার ডেলব্রিজ স্বভাবসুল্ভ অমায়িক হেসে আলতো হাতে যে বস্তুটা তুলে নিয়েছে সেটা দেখছি আস্ত মানুষের ঘিলু! ফর্মালিনে চুবিয়ে রাখায় কিছুটা ইলাস্টিক ভাব চলে এসেছে। ছাত্রদের একজন বনে গিয়ে হাঁ করে দেখতে থাকলাম। ভৌতিক-হরর সিনেমার পর্দা থেকে যেমন চাইলেও চোখ সরানো যায় না, তেমন একটা চুম্বক আকর্ষন কাজ করছে।
ডক্টর ক্লেয়ার বলে চলছে, ‘বয়স আশি পেরোনো। মৃত্যুর কারন, কোভিড ১৯ সংক্রান্ত জটিলতা। গবেষনার কাজে পরিবারের অনুমতি নিতে মৃতদেহ সংরক্ষন করা হয়েছে। আসো, আমরা এবার পুরো মস্তিষ্ক কেটে দেখাবো...।‘ পরের আধা ঘন্টা ছুড়ি, স্কালপেল আর ফরসেপে চড়ে মানুষের মাথার সেরিবেলাম, সেরিব্রাল কর্টেক্স ইত্যাদি ইত্যাদি যত খোপ-খোপর আছে, গোল গোল হতভম্ব চোখে সব ঘুরে এলাম। টেবিলের ওপর চাক চাক করে কাটা স্লাইসের সংখ্যা বাড়তে থাকলো।
‘দেখলে, বয়স কিংবা করোনার আঘাত ছাপিয়েও ঘিলুটা দারুন রকমের অক্ষত রয়ে গেছে।‘ ডক্টর ক্লেয়ারের গলায় সরল উচ্ছ্বাস। ওদিকে, কান্ড দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। মাথা তো আমরা কেটেকুটে খতম করে দিলাম। মুন্ডুবিহীন ধড়টা তাহলে কোথায়? রোমহর্ষক চিন্তাটা বাকি দিনের মত খিদে-টিদে একদম ঘুঁচিয়ে দিলো।
৪.
আরেকদিন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ফিরে যাবো। ভাবলাম, পেত্রাকে বিদায় বলে যাই। তিনতলায় চলে যাবার পর আলাপ হয় না আর আগের মতন। দেখি, সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ফোনে কথা বলছে উঁচু গলায়। কি যেন হারিয়ে গেছে। ফোন রেখে দিলে শুধালাম, ‘কি হারালো আবার? কোনো কাজে আসলে বলো না, হাত লাগাই।‘ পেত্রা ফোশ্ করে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, ‘আর বলো না, ডেথ সার্টিফিকেট মিসিং। একটু আগে একজন আত্মহত্যা করেছে। হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। সার্টিফিকেট সমেত এখন লাশ আরেকখানে যাবে। অপঘাতে মৃত্যু, তাই ময়নাতদন্ত হবে হয়তো। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার পর প্যারামেডিক দেখলো, আরে কাগজ কই? মাত্রই তো চাদরে ঢাকা স্ট্রেচারে রাখা ছিল।’
ছোট্ট একটা ভিমড়ি খেলাম শুনে। ওদিকে, পেত্রা রাগে দুঃখে রীতিমত গজগজ করছে, ‘গবেট একটা। পঞ্চাশ বছর বয়স মাত্র। হাতে আরো কত বছর ছিল। কই রিটায়ার করে দেশ-বিদেশ বেড়াবে, তা না ফটাশ্ করে মরতেই হবে...?‘ শুনে টুনে আমি চলেই যেতে পারতাম। কোনো কাজে আসবো না এখানে। কিন্তু কি কারনে যেন যেতে পারছি না। পেত্রার ফোন আসছে একের পর এক। ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছু একটা শোনার আশায়। ট্রোগারস্ট্রাসের অতি পুরানো প্যাথলজী ভবনের বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। এমন দিনে দেখছি মরেও শান্তি নেই।
এদিকে, ডেথ সার্টিফিকেট বাতাসে উড়ে গেল কিনা খোঁজার জন্যে লোকজনের একদল বৃষ্টির ভেতর রাস্তায় নেমেছে। আরেকদল জরুরি বিভাগের কোনা-কাঞ্চি খুঁজছে, যেখানে লোকটাকে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল। আর তৃতীয় এক দল রোগীর বিছানা-চাদর ধোয়ার যে লন্ড্রী আছে হাসপাতালে, বুদ্ধি করে সেখানে গিয়েছে।
আরো পাঁচটা ফোন চালাচালির পর পেত্রার ঠোঁটে স্বস্তির হাসি ফুটলো। লন্ড্রীর চাদরের ভাঁজে লুকিয়ে ছিল কাগজগুলো। আমিও হাঁপ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
ট্রেন সেটেশন বরাবর হাঁটছি। হঠাৎ এক তাড়া কাগজ উঁচিয়ে ইউরেকা কায়দায় দু‘জন ছুটে আসতে দেখলাম। অ্যাম্বুলেন্সের কাছে দাঁড়ানো বাকি দু’জন হাতের বিড়ি ছুড়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গাড়ির দরজা খুলে দিল তাদের জন্যে। সেই সুইসাইড খাওয়া লোকের গাড়ি নয় তো? হালকা উঁকি দেবার আগেই সশব্দে অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্যাঁ পোঁ বিকট সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি ছুটল পংখিরাজের গতিতে।
কত কি যে ঘটে এই আঠারো নম্বর ট্রোগার স্ট্রিটে। এখানে যা ঘটে, শহরের আর কেউ তা জানে না। সে কাহিনী প্যাথলজি ভবনের দেয়ালে লেখা থাকে চুনকামের কলমে। সাদা চোখে তার কিছুই দেখা যায় না। শুধু কান পাততে হয় খুব সন্তর্পনে। তাহলেই শোনা যায়, প্রার্থনা ঘরের অনুচ্চ ফিসফিস, ডিসেকশন রুমের ছুড়ি-স্কালপেলের সঙ্গত কিংবা কি শোকে মরে যাওয়া বিষন্ন লোকটার অন্তিম ছাড়পত্রের জন্যে অদ্ভূত অপেক্ষা। (সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:১৪