১
এলোমেলো কয়েক পাক ঘুরতেই ছোট্ট লিসবন বিমানবন্দরটা ফুরিয়ে গেল। ডিউটি ফ্রি শপে কেনাকাটা করার লোক নই। তারপরও এক-দুইটা পারফিউমের বোতল টিপেটুপে দেখলাম। অতি সুগন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসা ছাড়া আর কোনো লাভই হল না। মাথা ধরিয়ে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। আরো ঘন্টাখানেক কি করে কাটাই, চিন্তা লাগছে।
পর্তুগালের ফ্লাইট বাকিদের আগে এসে পৌঁছেছে। বাকিরা বলতে রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নানান ল্যাবের পিএইচডি ছাত্রছাত্রীরা। মিউনিখ থেকে প্রায় জনা দশেক এসেছি একটা কনফারেন্স ধরতে। সে কনফারেন্স আবার পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে অনেক দূরে। এস্তোরিল বলে কোন আরেক শহরে। ওরা এলে সবাই এক সাথে বাস বা ট্রেনে করে যাবো। তাই অনেকটা সময় হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে মাছি মারছি।
একঘেয়েমি কাটাতে শেষে এক রেস্তোরায় আশ্রয় নিতে হল। বাকি টেবিলগুলোতে অতিথি নেই। একমাত্র কাস্টমারের আগমনে ওয়েটার লোকটা তীরের মত ছুটে এল। তাকে দু’প্লেট সী ফুড আনতে পাঠিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছি। হেঁশেলে অর্ডার পৌঁছে দিয়ে ওয়েটার দেখছি আবার হাত ভাঁজ করে বিনীত দাঁড়িয়ে। অগত্যা তাকে এবার কোকাকোলার কথা বললাম। আলাদিনের দৈত্যের মত মুহূর্তেই সে বিশাল রূপালি থালায় টেলিস্কোপের মত সরু গ্লাস নিয়ে হাজির। কোক ঢেলে তাতে একটা রঙ্গীন ছাতা বসিয়ে দিল। গ্লাসের খাঁজে এক চাক লেবু বসে গেল খাপে খাপ। কারুকাজ করা কৃস্টালের বাটিতে আবার বরফ কুচিও আছে দেখছি।
আপ্যায়নের বহর দেখে অস্বস্তি লাগছে সামান্য। ‘মোমবাতি জ্বেলে দেই, ম্যাম? একটা মোলায়েম অ্যাট্মোস্ফিয়ার তৈরি হবে। বরফ শীতল পানীয়ে সুরুৎ সুরুৎ টান দিতে দিতে কোনোমতে বললাম,’উহু, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।‘ লোকটা এবার দৌড়ে গিয়ে পেল্লায় দু‘টো পেয়ালা নিয়ে এল। খাবার অর্ডারের হুকুম এত দ্রুত তালিম হতে আর কোথাও দেখি নি আগে। যাহোক, মাখনে হুঁটোপুটি খাওয়া চিংড়ি আর মচমচে কালামারির উষ্ণ মাতাল ঘ্রানে অলস সময়টাকে হঠাৎ খুব দরকারী মনে হল। গার্লিক সসে মুড়িয়ে গরমাগরম মুখে চালান দিতেই আবেশে চোখে বুজে এল। সময় কাটানোর এই অলস পন্থাটা নেহাত খারাপ না।
২.
ওদের আসার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। উঠে পড়লাম বিল চুকিয়ে আর দরাজ হাতে বখশিস মিটিয়ে । উত্তরে ওয়েটার লোকটা সাবেকি কায়দায় একটা ‘বাউ’ ঠুকে দিল। নতুন দেশে নেমেই এমন ভিআইপি আদর পেয়ে নিজেকে ভারিক্কী গোছের কেউকেটা মনে হচ্ছে। হৃষ্টচিত্তে বাকিদের খুঁজতে ‘অ্যারাইভাল‘ গেটে দাঁড়ালাম। একে একে আট-নয়জনের দলটা বেরিয়ে এল। গরমে তারা ঘেমে নেয়ে হদ্দক্লান্ত। খেয়ে দেয়ে নধর হয়ে যাওয়া চিকচিকে চেহারার আমাকে দেখে প্রথমেই তারা ভারি ভারি পোস্টারের খাপ দু’টো গছিয়ে দিল। আপত্তি না করে সানন্দেই সেগুলো কাঁধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলাম সবার সাথে।
এয়ারপোর্টের ভেতরটা যেমন বদ্ধ, বাইরেটা তেমনি খোলা। কচি পাতার ফাঁকে মৃদুমন্দ বাতাসে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। ২০১২ সালের মার্চ মাসের পর্তুগীজ রোদ যেন এক গাল হেসে আমাদের বরন করে নিল। ভীষন চটপটে মেয়ে ফ্রান্সিসকা দারুন দক্ষতায় অটোমেটিক টিকিট বুথের বোতাম চেপে এক রাশ টিকিট কেটে জনে জনে হাতে ধরিয়ে দিল। এস্তোরিলের বাস এসে স্টেশনে দাঁড়াতেই হুড়ুমুড়িয়ে চেপে বসলাম। পয়সা দিয়ে টিকিট কাটলেও বাসে তিল ধারণের জায়গা নেই। অগত্যা বাদুড়ঝোলাই ভরসা।
অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে মেড ইন জার্মানি মার্সিডিস বেঞ্জ মডেলের পুরানো বাসটা ক্যাঁচকোঁচ আর্তনাদ তুলে এগিয়ে চললো। চওড়া রাস্তা আর অট্টালিকা ফুরিয়ে যেতে সময় লাগলো না। বাকিটা শুধুই অলি গলি আর গায়ে গা ঘেঁষা ঘিঞ্জি বাড়ির সারি। আর দশটা ইউরোপীয় শহরের আভিজাত্য নেই তাতে। তবে আভিজাত্য নিয়ে মনে হয় এদেশের লোকের তেমন মাথাব্যথা নেই। যে যার মত উঁচু গলায় কথা বলছে বিরতিহীন। শিশুরা চ্যাঁওভ্যাও কাঁদছে তো মায়েরা কপট রাগ দেখিয়েই গল্পে ডুবে যাচ্ছে। তরুণেরা হাহা করে হাসছে তো বুড়োরা মোড়ের ক্যাফেতে হল্লা করে চুরুট টানছে। সব মিলিয়ে কথার কলেবরে আর হাসির কলোরবে দীনিহীন পর্তুগালের অলি গলিগুলো ভীষন রকমের উজ্জ্বল। কোন দেশের ট্যাঁকে কত কাগুজে নোট আছে, তা দিয়ে যে উন্নতি মাপা হয়, সেই হিসেবে পর্তুগাল ঠিক পড়ে না বটে তবে মাপকাঠিটা পয়সা-কড়ির বদলে যদি লোকের মুখের হাসি হত, তাহলে পর্তুগাল ঠিক পেনাল্টি খেলে গোল দিয়ে জিতে যেত। (চলবে)
ছবি সৌজন্যে, ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৪:২৩