- না! এদের নিয়ে তো আর পারছিনা!!
- কাদের নিয়ে?
জুয়েল আকাশের দিকে দেখালো। আমি দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়া বিমানটা দেখে একটা মুচকি হাসি দিলাম।
স্কাউট জাম্বুরী উপলক্ষে জীবনে এই প্রথম ঢাকায় আসছি। ঢাকার রাস্তার দোতলা বাস আর আকাশে উড়তে থাকা বিমান দেখলেই আমরা অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে থাকি। তবে, এগুলোর চেয়েও যে জিনিসটা এখন বেশি অবাক করতেছে, এত্ত কাছ দিয়ে বিমান উড়ে যায় অথচ ঢাকার মানুষগুলো সেদিকে ফিরেও তাকায়না!!
ঢাকায় সেবার মাত্র তিনদিন থাকার পর অবশ্য আমিও বুঝতে পারলাম তারা কেন তাকায়না। এক জিনিস কতবার দেখা যায়! আমার নিজেরই আগ্রহ কমে গেছে।
কিন্তু জুয়েল??!!
ওর চোখের ক্ষুধা মিটলেও মনের ক্ষুধা এখনো মেটে নাই। তাইতো, প্রত্যেকবার বিমানের শব্দ শুনলেই জুয়েল চেহারায় বিরক্তি অথচ মনে চরম প্রশান্তি নিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে। আর বিমানটা দূর আকাশে অদৃশ্য হলেই বলবে, "এদের নিয়ে তো আর পারিনা। এই শেষ, আর দেখব না।"
আমার বরাবরই ঢাকা শহরটা ভাল লাগে।
ময়মনসিংহে পড়ার সময়ও নিয়ম করে বছরে দুই তিনবার ঢাকা আসতাম। থাকতাম ভার্সিটির হল কিংবা বন্ধুদের মেছে। একবার ঠিক করলাম বন্ধু রিপনের সাথে ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকবো। পরদিন ভ্যালেন্টাইন্স ডে!! গার্লফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে যাবো, তাই একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাম।
রাত একটার দিকে হঠাৎ রিপনের ধাক্কায় ঘুম ভাঙলো। সে বলল, "একটু পর হোস্টেলে পুলিশের রেইড পড়বে, তোর এখানে থাকা ঠিক হবেনা।"
-এতো রাতে কই যাবো?
-সমস্যা নাই, রেডি হয়ে নে, আমি তোকে একজায়গায় রেখে আসতেছি।
আমি কোন রকমে প্যান্ট-শার্ট পড়ে রিপনের পেছন পেছন গেলাম।
ওদের ক্যান্টিন আর বাউন্ডারি ওয়ালের মাঝখানে, খুপরি ঘরের মত একটা জায়গায় রিপন আমাকে নিয়ে আসলো। ঘরটার ছাদ নাই। চাঁদের আবছা আলোতে দেখলাম আগে থেকেই এখানে আরো পাঁচ ছয়জন বসে আছে।
রিপন আমাকে রেখে চলে গেলো। জায়গাটার পাশেই ড্রেন, অজস্র মশা। সবাই চুপচাপ একটু পর পর হাত পা ঝাকিয়ে শরীরের উপর বসা মশা তাড়ানোর চেস্টা করছে। শব্দ করে মশা মারতেও ভয়। এই বুঝি কেউ এসে পড়বে।
নিরবতা ভেংগে হঠাত একটা ছেলে বলে উঠলো, "ওয়াও!! রুমের চেয়ে তো এখানেই ওয়াই-ফাই এর স্পিড ভালো পাচ্ছি। ৫০০ এমবির একটা মুভি পুরাটা ডাউনলোড শেষ। ওয়াও!!"
সবাই বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকালে, বেচারা চুপ হলো।
কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে আল্লাহই জানে। অসহ্য লাগছিল। আমি ফিসফিস করে আমার পাশের জনকে জিজ্ঞাস করলাম, "ভাই, এখানে এভাবে কতক্ষণ থাকতে হবে?”
উনি দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন, "চুপচাপ বসে থাকেন আর ভাবেন পুলিশ ধরলে থানায় কতক্ষণ থাকতে হবে।"
আমি মনে মনে ভাবছি, আমি কি কোন অন্যায় করেছি? পুলিশ আমাকে ধরবে কেন?
আমার ঠিক সামনে দাড়ানো ছেলেটা বলতেছে, "পুলিশ ধরলেও আমার কোন সমস্যা নাই। রমনা থানার ওসি আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু।"
আমি আবার ভাবনায় ডুবে গেলাম। আমার পরিচিত কেউ কি পুলিশে আছে? এই মুহুর্তে কারো কথা মনে পড়ছেনা। আমাদের হলের, মামুন ভাই এ বছর পুলিশ ক্যাডার পাইছে। যদ্দুর জানি উনি এখন ট্রেনিংয়ে আছেন। ওনার ফোন নম্বরটা কি মোবাইলে আছে? আর, সত্যি যদি ধরা পড়ি...?
আমার ভাবনা শেষ না হতেই, জুতার শব্দ শোনা গেলো।
কেউ হয়তো আসতেছে। আমরা সবাই একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলাম। এখন নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছেনা। শুধুই একটানা মশার পো পো শব্দ শোনা যাচ্ছে।
দরজার বাইরে থেকে কেউ একজন বললো, "কে? কে এখানে?"
আমরা দম বন্ধ করে বসে আছি। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেলো। দুইজন লোক ভিতরে ঢুকেই চিৎকার শুরু করলো, "তোমরা কারা? এত রাতে এখানে কি করো?"
আচ্ছা এরা কি পুলিশ? পরনে অবশ্য কারো পুলিশের পোশাক নাই! একজনের পরনে বাটিকের ফতুয়া অন্যজনের কমলা কালারের শার্ট।
ফতুয়া পড়া লোকটা বললো, "এরা যেহেতু লুকিয়ে আছে, তার মানে এরা কোন অন্যায় করেছে। এক এক করে সবাইকে সার্চ করো। কিছু পাওয়া গেলে এদেরকে চালান করতে হবে।"
সার্চ করার কথা শোনার সাথে সাথে ওয়াইফাই পাগল ছেলেটা কান্না শুরু করলো, "না স্যার, প্লিজ স্যার, সার্চ করবেন না স্যার"।
আমরা সবাই অবাক!! সার্চ করলে সমস্যা কি?
ফতুয়া পড়া লোকটা আবার তাড়া দিলো, "এই বদমাইশটাকে আগে সার্চ করো।"
কমলা শার্ট পড়া লোকটা, ওয়াইফাই ওয়ালাকে এক ধমক দিলো, "চুপ করে সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকবি"।
ওয়াইফাই বেচারা চুপ হয়ে গেলো। কমলা শার্ট লোকটা ওয়াইফাই ওয়ালার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকানোর সাথে সাথেই দুই জন একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
ঘটনা কি? আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না!
কমলা শার্ট চিৎকার করে বললো, "স্যার, এই হারামজাদার প্যান্টের পকেট ছেড়া! হারামজাদা নিচে আন্ডারপ্যান্টও পড়ে নাই!!"
আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো। ভয়ের চোটে আমি হাসতেও পারছিলাম না।
হঠাৎ আবার পায়ের শব্দ।
অবাক কান্ড! এবার আমাদের সাথে সাথে নতুন দুই জনও ভয় পেয়ে গেলো।
ভিতরে ঢুকলো ৫-৭ জন লোক। না, এদের পড়নেও পুলিশের পোশাক নাই।
নেতা টাইপ একজন জিজ্ঞাস করলো, "এরা এখানে কেন?"
ফতুয়া পড়া লোকটা বললো, "ভাই, এরা সব বহিরাগত। হলে আজকে পুলিশের রেইড পড়বে তো তাই এখানে লুকিয়ে আছে।"
নেতা বলল, "তোরা এখানে কি করতেছিস?"
কমলা শার্ট পড়া ভদ্রলোক বলল, "ভাই, হঠাৎ শুনলাম পুলিশের রেইড ক্যান্সেল হইছে। তাই ভাবলাম মুরগী গুলোকে একটু র্যাগ দিয়ে আসি।" বলেই সবাই একসাথে হো হো করে হাসতে লাগলো।
নেতা কিছু বললো না। খুবই স্টাইল করে একটা সিগারেট ধরালো। এরপর, হাত দিয়ে ইশারা করে আমাদেরকে রুমে ফিরে যেতে বললো।
বাইরে বের হয়ে দেখি রিপন হাসতেছে। সে জিজ্ঞাস করলো, "কিরে ভয় পাইছিস?"
আমি উত্তরে বললাম, "উঁ"।
আমার উত্তরে রিপন কি বুঝলো জানিনা। ওর হাসিমুখ আরো চওড়া হলো।
আজকে সেলুনে গেছি চুল কাটাতে। দুইটা ছেলে আগে থেকেই সেখানে আড্ডা দিচ্ছিলো। তাদের আলোচনার বিষয় ভার্সিটির র্যাগিং। দুইজনই কি খুশি মনে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের মুরগী হওয়ার গল্প করতেছে।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ২০০৮ সালে৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সে সময় নেতারা ছিলো পলাতক। তাই সেসময় আমাদের ক্যাম্পাসে কোন র্যাগিং ছিলোনা।
আমি দুই ছেলের একজনকে জিজ্ঞাস করলাম, "তোমরা হাসতেছো কেন? কেউ র্যাগ দিলে তোমাদের খারাপ লাগে না?
-না ভাই। আমার তো মজাই লাগতো। মাত্র তো কয়টা দিন কস্ট করতে হবে। একবার ভেবে দেখেন সামান্য কস্টের বিনিময়ে কত বড় জিনিস আমরা শিখতে পাচ্ছি।
-বুঝলাম না!! কি শিখতে পাচ্ছো?
-শোনেন। আপনি তো চাকরি করেন? তাইনা...? চাকরি জীবনে আপনার কত শত টাইপের খারাপ মানুষ নিয়ে ডিল করতে হয়। আপনিই বলেন, আমাদেরকে র্যাগ দেওয়া এই দুই একজন শিক্ষিত বাইঞ্চোদ কি ওইসব খারাপ মানুষের চেয়েও ভয়ংকর? সামান্য কস্টের বিনিময়ে এইসব বাইঞ্চোদদের ডিল করা শিখতেছি, এটা কম নাকি?
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
আজকে সন্ধায় আমার বাসার বারান্দায় বসে আছি। এই বারান্দা থেকে এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যায়। আজকে একের পর এক বিমান উড়ে যাচ্ছে। বিমানের ওড়া দেখে আজকে কেন জানি খুব আনন্দ লাগতেছে। অকারনে বন্ধু জুয়েলের কথাও খুব মনে পড়তেছে। আজকে জুয়েল সাথে থাকলে ভালো হতো, দুইজন আরাম করে বিমান দেখা যেতো।
গল্পের পেছনের গল্পঃ
আমার বউ যখন প্রেগন্যান্ট। তখন রাতভর আমরা দুইজন গল্প করতাম। মাঝে মাঝে পেটে থাকা আমার বাচ্চার সাথে অদ্ভুত এক অর্থহীন ভাষায় কথা বলতাম। বউ রেগে গিয়ে বলতো, "কি সব হিব্রু ভাষায় কথা বলতেছো।"
ছেলে হওয়ার পর, বউ এখন বাপের বাড়িতে। গতকাল বউ, ম্যাসেঞ্জারে আমার ছেলের একটা ভিডিও পাঠিয়ে লিখেছে, "দেখছো, তোমার ছেলেও হিব্রু ভাষায় কথা বলতেছে।"
তিন মাস বয়সের আমার ছেলেটার সাথে ওর মা সারাদিন গল্প করে, সুখ-দুঃখের কথা বলে। ছেলেও মায়ের কথার জবাব দেয়ার জন্য কি স্ট্রাগলটাই না করতেছে। আমার মন ভরে গেলো। চোখে পানি চলে আসলো।
মন থেকে থেকে এই দোয়া বের হলো, "আলহামদুলিল্লাহ। বাবারে, আল্লাহ তোকে অনেক বড় করুক। জীবনে চলার পথে বেশিরভাগ সময়ই আজব সব পরিস্থিতিতে পড়বি। হাসি মুখে সেই সব পরিস্থিতি পার করলেই দেখবি জীবনটা কত্ত সুন্দর। কস্ট ছাড়া পাওয়া আনন্দের মধ্যে সুখ আছে নাকি? তোর মা, ছোটবাবা (চাচা) আর মামাকে হিব্রু ভাষাটা শিখিয়ে দিস তো। এরা সামান্যতেই কেমন অস্থির হয়ে যায়। দোয়া করছি, তোর বলতে শেখার স্ট্রাগল দেখে, আমার মতই যেন এরাও নিজেদের জীবনের স্ট্রাগলে প্রেরণা পায়।"
ছবি ক্রেডিটঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২১ দুপুর ২:৫৫