দিপুল ভাইকে হঠাৎ করে দিপুল-ওস্তাদ ডাকতে কেমন কেমন জানি লাগতেছে। দিপুল ভাইয়ের ড্যান্স গ্রুপে ভাইয়ের বদলে ওস্তাদ ডাকাটাই নাকি নিয়ম। যা হোক, আমি আসছি দিপুল ওস্তাদের কাছে নাচ শিখতে।
এরও কিছুদিন আগের ঘটনা। জীবনে প্রথমবার ফ্যান্টাসি কিংডমে ঘুড়তে গেছি। আমাদের সাথে ছিল মোয়াক্ষের আলম সোনা স্যার। অনেকগুলো মজার মজার রাইড এনজয় করার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশের মঞ্চে কনসার্ট চলতেছে। অবাক করা বিষয় হলো, দর্শক সাড়ির সবাই গানের তালে তালে সেই রকম আনন্দে নাচতেছে। গ্রাম থেকে প্রথমবার ঢাকায় আসা আমার কাছে ব্যাপারটা একেবারেই নতুন। আমি হা করে সবার নাচ দেখতেছিলাম। মোয়াক্ষের স্যার ধমকের সুরে বললেন, “হা করে কি দেখো? আসো নাচি!!” বলেই স্যার কোমর দুলিয়ে নাচ শুরু করলেন।
ইস! সবাই কি আনন্দটাই না করতেছে!! আমি নাচতে পারিনা। মনে মনে ঠিক করলাম, এবার বাড়ি ফিরে নাচ শিখতে হবে। আমাদের এলাকায় রিসেন্টলি বেশ কয়টা নাচের গ্রুপ শুরু হইছে। আমার অনেক বন্ধু শেখানে নাচ শিখতে যায়।
দিপুল ওস্তাদের ড্যান্স ক্লাসের প্রথম দিনের প্র্যাকটিস শেষে ওস্তাদ আমাকে আলাদাভাবে ডেকে নিলেন।
বললেন, “তোমার নাচ শেখার দরকার নাই। নাচ শিখতে গিয়ে পড়াশুনার অনেক ক্ষতি হবে”।
-"কোন সমস্যাই হবেনা"।
আমি ওস্তাদকে অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হলো না। ওস্তাদ আমাকে গ্রুপে সুযোগ দিলেন না।
পরে অবশ্য ওই গ্রুপেরই একজনের কাছে শুনলাম, আমার বন্ধু লিমন, দিপুল ভাইকে আমার ব্যাপারে না করতে বলছে। ওই সময় আমার সাথে লিমনের দা কুমড়া সম্পর্ক ছিলো। আবার, লিমন ছিলো দিপুল ভাইয়ের গ্রুপের সবচেয়ে ভালো ড্যান্সার।
এই ঘটনা শোনার পর, আমার বন্ধু হযরত আলী আমাকে বিপ্লব ভাইয়ের ড্যান্স গ্রুপে নিয়ে গেলো। বিপ্লব ভাই হযরত আলীর আত্মীয়। সব শুনে ভাই আমাদেরকে নাচ শেখাতে রাজি হলেন। এক সপ্তাহ পরেই আমাদের স্কুলে একটা নাচের প্রতিযোগিতা হবে। ভাই বললেন, ঐ প্রতিযোগিতার জন্য আপাতত হযরত আলীকে নাচ শেখাবেন, পরে আমাকে। মাত্র এক সপ্তাহ নাচ শিখে, হযরত আলী সেই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলো!! ভাবা যায়...!!
আমি কিন্তু মনে মনে খুব খুশিই ছিলাম। কপাল গুনে এবার পাকা ওস্তাদ পাইছি। কিন্তু অপেক্ষার দিন শেষ হয়না। কোন বিশেষ কারনে, বিপ্লব ভাইয়ের ড্যান্স গ্রুপের কার্যক্রম বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকলো। অপেক্ষা, অপেক্ষা অপেক্ষা...। না, শেষ পর্যন্ত এখানেও আমার নাচ শেখা হলো না।
ভার্সিটিতে ভর্তির পর, সাংস্কৃতিক সংগঠনের এক বড় ভাইকে নাচের ব্যাপারে আমার আগ্রহের কথা জানালাম। ভাই বললেন, আমাদের ক্যম্পাসে নাচার জন্য দুইটা শর্ত। এক, আগে থেকেই নাচে এক্সপার্ট হতে হবে! দুই, ক্যম্পাসে গার্লফ্রেন্ড থাকতে হবে!! ক্যাম্পাসে ডুয়েট নাচ তখন খুবই জনপ্রিয়। গার্লফ্রেন্ড থাকলেই কেবল কাউকে নাচ শেখানো হবে!!
না, অনেক চেস্টা করেও ক্যাম্পাসে নাচার জন্য একটা পার্টটাইম গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করতে পারলাম না।
কিছুদিন পর, স্কাউটের এক প্রোগ্রামে গিয়ে পরিচয় হলো আনন্দ মোহন কলেজের মিল্কি ভাইয়ের সাথে। যদ্দুর জানলাম, মিল্কি ভাই প্রায়ই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে নাচ করে। ইনিয়ে বিনিয়ে সেই প্রোগ্রামের সমাপনী অনুষ্ঠানে ওনার সাথে ব্যাকগ্রাউণ্ডে নাচার আবদার করলাম। উনি কোন রকম ফরমালিটি ছাড়াই বললেন, "বুঝছি, আপনি আমার পারফরমেন্স নষ্ট করার পায়তারা করতেছেন"? আমিও নাছোড় বান্দা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা বুদ্ধি বের করলাম। শেষমেশ, তার দেশাত্ববোধক নাচের ব্যাকগ্রাউন্ডে, তালে তালে শাপলা ফুল, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ হওয়ার সুযোগ হলো। সেই কিন্ডারগার্টেনের ডিসপ্লে গুলোর মতো। খারাপ কি? দুধের স্বাদ ভাতের মাড়ে তো মিটলো।
আমার আগ্রহের কারনে মিল্কি ভাই যাওয়ার সময় এক ওস্তাদের ঠিকানা দিলেন। সেই ওস্তাদের সাথে যোগাযোগ করে জানলাম, ওনার কাছে মাসিক ৮ দিন নাচ শেখার ফি ২৫০০ টাকা! সেসময়, আমি মাসে ২৬ দিন টিউশনি করিয়ে পেতাম ১৫০০ টাকা!! মনটাকে বোঝালাম এতো বিলাসিতা ভালো না। আর এইসব নাচানাচির ব্যাপারে ধর্মে নিষেধাজ্ঞা আছে!!! আংগুর ফল টক।
মাস্টার্সে পড়ার সময়, হঠাৎই আশার আলো হয়ে সামনে এলো একটা ফেসবুক পোস্ট। আমাদের ভার্সিটির ছোটভাই সামসুজ্জামান সুমন নাচ শিখতে আগ্রহীদের নাচ শেখাবে। সুমনের সাথে আমার সম্পর্ক সহোদরের মত। এবার আমাকে আর ঠেকায় কে?
আমি সাথে সাথেই সুমনকে ফোন দিলাম। সুমন ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, ‘ভাই, এখানে সব জুনিয়র পোলাপাইন নাচ শিখবে, আপনি লজ্জা পাবেন’। আমিও ছাড়ার পাত্র না। বললাম, ‘শিল্পকলা শেখার ব্যাপারে লজ্জা কিসের, আমার কোন সমস্যাই হবেনা’। আমাকে কোনভাবেই না মানাতে পেরে সুমন বেফাঁস বলে ফেলল, ‘ভাই, আপনার আগ্রহের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আপনি লজ্জা না পেলেও জুনিয়ররা ঠিকই লজ্জা পাবে’। এরপর, আমি আর কোন যুক্তি দেখাতে পারলাম না।
ভার্সিটি ছেড়েছি প্রায় ছয় বছর আগে। চাকরি, বঊ, সংসার আর ছেলেকে নিয়ে বৈচিত্র্যহীন ছাপোষা জীবন। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর, আমার দায়িত্ব থাকে ছয় মাস বয়সী আমার ছেলেকে দেখে রাখা। আমার বউ এই সময়টায় রাতের রান্নাবান্না করে। আমি হাজারো কশরত করে ছেলের কান্না থামিয়ে রাখি। কখনো ছেলের সাথে খেলাধুলা করি, গান গাই, অভিনয় করি কিংবা কবিতা আবৃতি করি। গতকাল কোন কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছেনা দেখে শুরু করলাম নাচ!!
সর্বনাশ!! ছেলে আমার হো হো শব্দ করে হেসে উঠলো। বউ রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞাস করলো, কি হইছে?
কি উত্তর দেব? বললাম, এটা আমাদের বাপ-ছেলের সিক্রেট। তোমাকে বলা যাবে না।
বউ গজরাতে গজরাতে চলে গেলো। এরপর থেকে আমি আছি মহা টেনশনে।
আমার ছেলের এই হাসির অর্থ কি?
আমার নাচ কি খুবই সুন্দর হইছে, নাকি সেই লেভেলের হাস্যকর হইছে ??
গল্পের পেছনের গল্পঃ
ছেলের সাথে সময়গুলো কাটিয়ে বুঝতে পারতেছি, ছোট্র বাচ্চাদের লালন পালন করা কোন ছেলেখেলা না। কত শত ট্রিক্স করে ছেলেকে শান্ত রাখতে হয়। গান, নাচ, অভিনয়ের কোন একটা ট্রিক্স রিপিট করলেই ছেলে এমনভাবে তাকায়, মনে হয় বলতে চাচ্ছে, "বাবা, তোমার স্টক শেষ নাকি"। ছেলের হাসির জন্য আবার নাচের ক্লাসে ভর্তি হওয়া যায় কিনা ভাবতেছি।
নাচ জিনিসটা বরাবরই আমার ভীষণ পছন্দের। আমি নিজে নাচতে পারি না। যারা ভাল নাচতে পারে আমার কেন জানি মনে হয় তাদের সাথে ঈশ্বরের সরাসরি কোন কানেকশন আছে। আমার বউ নাচ একদমই পছন্দ করে না। বলে, এইসব নাচানাচির ব্যাপারে ধর্মে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। আমি ধর্ম-কর্ম ভালো বুঝিনা। স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাটাও কোনদিন খোঁজা হয় নাই।
ছবিঃ গুগোল।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:২৫