somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাইকেলে সারা বাংলাদেশ ভ্রমন -২

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৯১ সাল ।
সম্ভবত : অক্টোবর মাস ।
আমাদের অসমবয়েসী পাঁচবন্ধু আমি, জেসিন,স্ট্যালিন ,বকুল ভাই ও আঞ্জু ভাইকে নিয়ে
দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকায় ছোট একটা ফিচার লিখেন সাংবাদিক ফজলুল বারী ভাই ।


এই ফিচারটির জন্য ছোট শহর নারায়াণগঞ্জে পরিচিত মহলে আমরা রীতিমতন বিখ্যাত ।
পথেঘাটে কারো সাথে দেখা হলেই প্রথম প্রশ্ন ছিল, কবে যাচ্ছ সাইকেল ট্যুরে ?
আমি বা আমরা ভাব নিয়ে বলতাম, যাব যাব ... প্র্যাকটিস চলছে । শেষ হলেই যাব ।
কিন্তু আসল ঘটনা হল আমাদের মধ্যে একমাত্র আঞ্জু ভাইর সাইকেল ছিল । বাকী চারজনের কারো সাইকেল ছিল না ।
তাহলে সাইকেল ট্যুর হবে কিভাবে ?
সাইকেলের দুঃশ্চিন্তায় মাথার চুল পড়ে যাবার যোগাড় !
কি করে যে একটা সাইকেল ম্যানেজ করি ! অনেক সাহস করে একদিন মা কে বলি । বাবাও শুনেন। কিন্তু কিছু বলেন না । আমি বুঝতে পারি একটা সামান্য সাইকেলের চাওয়াটা আমার চাকুরীজীবি বাবার পক্ষে মেটানো সম্ভব ছিল না । মধ্যবিত্তের সন্তানের অনেক চাওয়া পাওয়াই যেমন অপূর্ণ থেকে যায় , তেমনি আমারও থাকে।
সারাদিন মন খারাপ করে এর সাথে ওর সাথে কথা বলি ।
কিন্তু সাইকেল ছাড়াই মনের ভেতর স্বপ্নটা বড় হতে থাকে । যেভাবে হোক আমি ট্যুরে বের হবোই ।
আমার সাথে সাইকেল ট্যুরে যাবার জন্য আরো অনেকে আগ্রহ দেখায় । প্রতিদিন কত রিকোয়েস্ট,’ আমাকে তোমাদের সাথে নাও ।‘ আমার অনেক বন্ধু আছে যাদের নিজের রেসিং সাইকেল আছে । তারাও যেতে আগ্রহ দেখায় । দিন দিন সংখ্যাটা বাড়তে থাকে ।
প্রতিদিন বিকেলে আমরা তোলারাম কলেজের শহীদ মিনারে বসে নানান পরিকল্পনা করি । ট্যুরের জন্য আমাদের প্রস্তুতি কি হবে ,টাকা পয়সা কত কি লাগবে তারও হিসেব নিকেশ চুড়ান্ত করি ।
একদিন জেসিন , আঞ্জু ভাই মিলে আমরা দিনক্ষন ঠিক করি ১৫ ডিসেম্বর সকালে বাংলাদেশ দেখার জন্য বের হয়ে যাব ।
দিনক্ষন যত ঘনিয়ে আসতে থাকল ততই আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা কমতে থাকে ।নানান ছুতোয় সবাই কেটে পড়ে । শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলাম আমরা সেই পুরানো পাঁচজনই ।
জেসিন , স্ট্যালিন , বকুল ভাই সাইকেল জোগাড় করে ফেলেছে । আঞ্জু ভাইরতো আগেই ছিল ।
জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় গাউসের সাইকেলটা স্ট্যালিনের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি পড়ে যাই বিপদে ।
এখন আমি সাইকেল কোথায় পাই ।
হাতে মাত্র ৪দিন সময় আছে । ভাবতে ভাবতে খোঁজ পেয়ে যাই আমার এক বন্ধু শাহিনের ছোট ভাই শামিমের লাল রঙের একটা ইন্ডিয়ান এভন সাইকেল আছে ।
একদিন শাহীনকে পটিয়ে পটিয়ে রাজি করে ফেলি সাইকেলটা ধার দেয়ার জন্য । ৪/৫ দিন পর আবার ফেরত দিয়ে যাব । শাহীন আমাদের পুরো বিষয়টা জানত বলে একটু গাইগুই করে । কন্ডিশন একটাই সাইকেল যেরকম নিবো , ঠিক সেরকম অবস্থায় ফেরত দিতে হবে । আমি রাজী হয়ে ওদের বাসা থেকে সাইকেল নিয়ে আসি । টায়ার, টিউব চেঞ্জ করতে হবে । একটা নতুন রিং বেল লাগাতে হবে । সব মিলে ৪/৫শত টাকার মামলা ।
আমার হাতে তেমন একটা টাকা পয়সা নেই । মায়ের অগোচরে বাসায় জমে থাকা পুরানো খবরের কাগজ জড়ো করে ফেরিওলার কাছে বিক্রয় বাবদ প্রায় দেড়শ টাকা পাই । পকেটের কিছু টাকা মিলিয়ে মিশনপাড়ায় তাহেরের রিক্সার গ্যারেজে সাইকেল মেরামত করে ফেলি । সাইকেল এখন বাংলাদেশ চষে বেড়ানোর জন্য প্রস্তুত ।
এদিকে নারায়ণগঞ্জে বিজয় মেলা অনুস্টানের অনেক দায়িত্বও আমার কাঁধে । সাইকেল ট্যুর আর বিজয় মেলার কাজ মিলে আমার তখন নাভিশ্বাস । একাত্তুরের ঘাতক-দালাল নির্মূল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন জাতীয় সমন্বয় কমিটির জেলা শাখার সদস্য ছিলাম। প্রেস রিলিজ থেকে শুরু করে নানাবিধ সাংগঠনিক কাজে আমি বাসদের কর্মী হিসেবে সক্রিয় । সমন্বয় কমিটির অফিস ছিল আমাদের নারায়ণগঞ্জ জেলা বাসদ কার্যালয় । ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মর্গ্যান স্কুলে বিজয়মেলা উদ্বোধন করেছিলেন । মেলা শুরু হয়ে যাবার পর কিছু কাজ আমি অসিত দা’র উপর ছেড়ে দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরে যাই । পরের দিন খুব সকালে আমরা যাত্রা শুরু করব হাজীগঞ্জ থেকে ।
আগেই আমাদের কথা হয়েছিল সবাই চাষাড়া বালুর মাঠ জমায়েত হবে সকাল ৮টায় । যথারীতি আমি সবার আগে শানুভাইর টঙ্গয়ের চায়ের দোকানে হাজির । আমার পকেটে মাত্র ১২টাকা । অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চা- সিগারেট খেয়ে ১০টাকা শেষ করে ফেলি । পকেটে থেকে যাওয়া এই ২টাকা সম্বল করে বেড়িয়ে পড়ি সাইকেলে সারা বাংলাদেশ ভ্রমনে ।
সেইদিন খুব সকালেই শীত উপেক্ষা করে আমাদের অনেক বন্ধু এসেছিলেন বিদায় জানাতে । সুমিত, পাপ্পু,ফেরদৌস , রাজিব,আসাদ ,মুকুল,অন্তু ,ফয়সাল,ফারুক সহ অনেকেই । বন্ধুরা জানত কিন্তু আমাদের কারো বাসায় জানত না যে ,আমরা সাইকেলে বাংলাদেশ ভ্রমনে যাচ্ছি । আমি ৪/৫দিনের জন্য বরিশাল ঘুরতে যাচ্ছি বলে এসেছি । সত্যি বললে পুরা প্ল্যানই ভেস্তে যেত । অন্যরা যে যার মতন যা পেরেছে তাই বলে এসেছে ।
আমাদের প্রথম যাত্রা ছিল কুমিল্লা । তারপর একের পর এক জেলা সদর ।এইভাবে পুরো চট্রগ্রাম ও পার্বত্য বিভাগ ঘুরে দেখা হয়েছে।
সাড়ে তিনমাসে আমরা প্রথমে চট্রগ্রাম ও পার্বত্য বিভাগের সব জেলা , দ্বিতীয় সিলেট বিভাগ শেষে নরসিংদী দিয়ে ঢাকা বিভাগের শুরু করে কিশোরগঞ্জ দিয়ে পূরা ঢাকা বিভাগের সব জেলা শেষ করেছিলাম । ফরিদপুর থেকে আমরা গোপালগঞ্জ হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম খুলনা বিভাগে । খুলনা বিভাগের সব জেলা শেষে আমরা বাগেরহাট থেকে পিরোজপুরের মধ্য দিয়ে বরিশাল বিভাগে ঢুকে পড়েছিলাম । বরিশাল বিভাগ শেষ করে আমরা বিপদেই পরে গেলাম । কারন আমরা চাইছিলাম না এক জেলার উপর দিয়ে দ্বিতীয়বার সাইকেল চালিয়ে যেতে ।
বরিশাল সদরে সার্কিটহাউজে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা খুলনা থেকে ট্রেনে আবার চুয়াডাংগা যাব । এর আগে আমরা রাজবাড়ি থেকে এইখানে এসেছিলাম । খুলনা বিভাগের মেহেরপুর , কুস্টিয়া আমাদের বাকী ছিল । চুয়াডাংগা থেকে আমরা মেহেরপুর , কুস্টিয়া ঘুরে খুলনা বিভাগ শেষ করি । এরপর আমাদের যাত্রা শুরু হয় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ ।
টানা সাড়ে তিন মাসে আমরা চারজন সাইকেলযোগে সারা বাংলাদেশ ঘুরে শেষ করি । আমাদের খুলনা বিভাগ শেষ হবার আগেই বকুল ভাই বাগেরহাট থেকে নারায়াণগঞ্জ ফিরে যান ব্যাকপেইনের জন্য ।
মাত্র ২টাকা সম্বল করে কিভাবে ৬৪টি জেলা সদর ঘুরে এলাম এই কথা না হয় আরো একদিন বলা যাবে ।
তবে শুধু বলতে চাই ,এদেশের সাধারন মানুষের অফুরান ভালবাসার ঋণ কখনোই শোধ হবার নয় ।

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×