somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক নগর ফানুস (একটি ফাস্ট গল্প)

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘরে নীলচে আলো জ্বলছে।সোফায় পা ছড়িয়ে আঁধশোয়া হয়ে আছেন রাশেদ সাহেব। প্রায় শব্দহীন টিভিটিতে চলছে হিন্দি গানের দৃশ্য।টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই তিনি হাল্কা স্বরে ডাকলেন,
-তোফাজ্জল সাহেব!
নীল সার্ট, সাদা টাঈ পড়া একটা পেট মোটা লোক তৎক্ষনাৎ ঘরে ঢুকে গেল। মুখে তেলতেলে ভাবটা আরো তৈলাক্ত করে বলল,
-স্যার! কাজ শুরু করব স্যার?
-হুম।
-এক পেগে কয়টা আইস দিব স্যার?
-একটা। আপনি এক কাজ করুন তোফাজ্জল, তিন পেগ একবারে রেডী করে চলে যান।
-জি স্যার। স্যার টাকাটা যে দিতে হবে।
-কত?
-সাড়ে-তিন হাজার টাকা স্যার।
তোফাজ্জল হোসেন টাকাটা নিলেন। বিদুৎ গতিতে তিন পেগ সোনালী পানি তৈ্রি করে রাশেদ সাহেবের সামনে রেখে আবার ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তৃষ্ণার্তের মত প্রথম চুমুকটা দিতেই মুখ বিকৃত করে ফেললেন রাশেদ সাহেব। পর পর আরো দু-চুমুক খেয়ে তিনি বাজখাই কন্ঠে ডাকতে লাগলেন,
-তোফাজ্জল।এই তোফাজ্জল!
তোফাজ্জল এবার একটু হেলেদুলে ঘরে ঢুকলেন।
-জি স্যার।
-তুমি শালা এটা কি জিনিস দিয়েছ। এত ধরলো কেন?
-তাহলে স্যার আর না খেলেন আজ।।
-খাবো না তো কি করব? মাল ছাড়া সারা রাত যাবে নাকি!এটা কোথা থেকে এনেছ?
-আপনি যেখান থেকে আনতে বলেন সেখান থেকেইতো। আর ঐ একি ব্রান্ড। স্যার কি বোতলটা দেখবেন?
-রাখ তোমার বোতল। যত্তসব স্টুপিড এসে জোটে।
তোফাজ্জল হোসেন আর দেরি না করে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। একটু পর আবার তার ডাক পড়ল। এবার আরো দেরিতে ঘরে ঢুকল সে। তার কন্ঠ বিষন্ন ,
-জি স্যার।
-ওই হারামজাদা এইটা কি আনছিস রে।তিন পেগ পড়তেই হাত-পা নাড়াতে পারছি না।
-স্যার তাহলে উপরে চলে যান। আর খেতে হবে না।
-তুই আমাকে শিখাস খেতে হবে কি না হবে!আরো তিন পেগ বানিয়ে দিয়ে চলে যা। এই বাড়ির ত্রিসিমানায় তোকে যেন আর না দেখি।
রাশেদ সাহেবের গালাগালে তোফাজ্জল হোসেন পিঠ পেতে দিলেন। আরো তিন পেগ বানিয়ে ঘর ছেড়ে গাড়ি বারান্দায় এসে সেও রাশেদ সাহেবের মত বাজখাই স্বরে ডাকতে লাগলেন,
-সোহেল!এই সোহেল।
টাঈট জিন্স আর টি-সার্ট পড়া একটা ছেলে প্রায় দৌড়ে এল।
-জি স্যার।
-স্যারকে উপরে নিয়ে যেতে হবে। নেশা ধরে গেছে মনে হচ্ছে।
-এত তাড়াতাড়ি!কিন্তু বেশি নেশা ধরলে ম্যাডামতো উপরে উঠতে দিবেন না।
হঠাৎ জনাব তোফাজ্জল সোহেলের একটু কাছ ঘেসে ফিসফিসিয়ে বললেন,
-কি মাল আনছো মিয়া? ধাগ বেশি।
-আরে কি কন স্যার !আমি এক নম্বর জায়গা থেকে আনছি। মেড ইন বাংলাদেশ আর কি; তাই একটু ইয়ে মানে…
-হুম।
-স্যার দামটা দিতে হবে তো।
-কত যেন?
-দুই হাজার।
-মিয়া ইয়ার্কি কর? দুই-নাম্বার মাল দুই হাজার!
-স্যার মিছা কইলে নিজের মাথা খাই। তাছাড়া কালার আর গন্ধ দেখছেন? একদম ডুপ্লিকেট। স্যার টাকাটা দেন নিজের পকেট থেকে নিজে গিয়া নিয়া আইছি।আমি ছোট ভাই, এক-দুইশো টাকাতো লাভ করমুই তো।
তোফাজ্জল হোসেন এদিক ওদিক তাকিয়ে টাকাটা বের করে দিয়ে চলে গেলেন। সোহেল শীষ দিতে দিতে টাকাটা টাঈট জিন্সের পকেটে গুজতে থাকে।সে এই মূহুর্তে রাশেদ সাহবের ঘরে যাবে কি যাবে না ঠিক করতে পারছে না।হঠাৎ তাকে দাঁড়োয়ান হাঁক দিয়ে বলে,
-সোহেল সাব একজন আপনারে ডাকে।
-ভেতরে আইনো না। আমি আসতাছি।
একটা হাড় জিড়জিড়ে বুড়ো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সোহেলকে দেখতেই সে পান খাওয়া লাল দাঁত দেখিয়ে একটা বিরাট আকারের একটা হাসি দিল কিন্তু সোহেল তাতে খুশি হল না।তাকে নিয়ে একটু দুরে গিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
-বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতাছ কে হরিপদ? তোমারে না কইছি বাড়ির আশেপাশে আসবা না। আমিই গিয়া দিয়া আমু। তোমরা ছোটলোক মেথর তাই কথার দাম দাও না।
-কি বোলেন যে বাবু। ছেলে-মেয়ে লিয়ে দুটো রোটি খেতে পাইনা। টাকাটা লিয়েই চলিয়া যাব।
-কত হইছে জানি?
-ছক্কাল ছক্কাল ইতো বলে গেলাম পন্দারোছো টেকা। দিয়ে দিন না বাবু বাজার লিয়ে যাইতে হবে।
সোহেল আশেপাশে তাকিয়ে গুনে গুনে সাতশো টাকা হরিপদের হাতে দিয়ে বলল,
-নে। সাতশো টাকা রাখ। এইটাই বেশি দিছি আর কোন কথা কবি না।
-নেহি বাবু। বাকি টেকাটা দিয়ে দিন। বহুত বড়া পরিবার,পেট জিয়াদা।
হরিপদের চাপাচাপিতে সোহেল তার মানিব্যাগ থেকে খুচরা আড়াইশো টাকা বের করে হরিপদের হাতের মুঠিতে টাকাটা গুজে দিল,
-আর একটা আওয়াজ করবি না বুইড়া। চুপচাপ রাস্তা মাপ।
হরিপদ মুখ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ পেছন থেকে অনুরোধ করতে থাকে সোহেলকে। তারপর চোখের আড়াল হতেই একটা কুৎসিত গালি দিয়ে হাটতে থাকে। নিজেকে এখন রাজার মত লাগছে তার। ঘরে না ফিরে গিয়ে পিয়ারির ঝাপরিতেই আজ রাতটা কাটাটে পারে। ভাবতে ভাবতে বড়রাস্তা পাড় হয়ে চিকন গলিটাতে ঢুকতেই তার কাধে শক্ত করে চাপড় পড়ল,
-কি অল্ড ম্যান!টাকাটা দিতে আমার ঘরে যাওয়ার কথা ছিল না?
হরিপদ আমতা আমতা করতে করতে থাকে।
-ছাব। টেকাটা এখনো পাইনি। কাল যাকে লিয়ে আসবো। আপকো ভী দিয়ে আছবো।
-শালা মাউড়া। তোর হাড্ডি-গুড্ডি গুড়া করে টুথ-পাওডার বানিয়ে ফেলবো কিন্তু। আমার সাতশো টাকা দে চুপচাপ।
ল্যাম্পপোষ্টের ম্লান আলোয় নিরবকে একটু দেখে নেয় হরিপদ। তার যতটুকু মনে হয় ছেলেটা বড়লোকের ঘর তাড়ানো,তার উপর গাজাখোড়। এর শরীরের জোড় তার চেয়ে কমই হবে।এক ঝলক দেখেই আর অনুনয় বিনিনয় না করে একটু জোড়ই দেখায়,
-বলাতো সাব কাল লিবেন। আপকা হাত উঠাতো মেরা ভী উঠেগা।
মুখের কথা শেষ না হতেই পেটের কাছে ধাতুর ঠান্ডা নলটার পরশে তোতলাতে থাকে হরিপদ।
-আসলেই টেকা আজ পাই নি বাবু। ঠিক আছে পকেটে যিতনা হ্যায় তাই লিয়ে যান।
হরিপদ পকেট থেকে খুব কায়দা করে পাঁচশো টাকা বের করে।নিরবের পুরিয়া নেয়ার সময় হয়ে গেছে। তাই আপাতত সে কিছুটা সন্তুষ্ট হয়েই আর কথা বাড়ায় না। হাত উঁচিয়ে বলে,
-ঠিক আছে আমি কাল এসে বাকিটা নিয়ে যাব আঙ্কেল।
হরিপদ অন্যমনস্কক মাথা নাড়ে।সে বাকি সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে বাসায় যাবে না পিয়েরির ঝুপরিতে যাবে ঠিক করতে থাকে। আর নিরব দ্রুত পায়ে ছুটতে থাকে সামনের বস্তির দিকে। একই রকম চেহারার ঝুপরি হতে বিশেষ ঝুপরিটা চিনে নিতেই আরো দ্রুত প্রায় দৌড়ে ঢুকে যায় ভেতরে। কুপির ম্লান আলো জ্বলছে, কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে যার কাজে ব্যস্ত।মাঝ বয়সী একলোকের দিকে নিরব টাকাটা ছুড়ে দিল,
“চারশো টাকা তোমার মালের দাম।বাকি টাকা ভাঙ্গতি করে আমার পুরিয়া দাও”।
নিজের পুরিয়াটা বুঝে নেয়ার আগেই সে আর একজনের হাত থেকে একটা নিয়ে জোর টান দিল। অপরিচিত মুখটি তাতে রাগ না হয়ে খুব পরিচিত একটি হাসি দিল।হাসিটা তাকে ভাবালো না।দূর্ভিক্ষের ক্লিষ্ট মানুষের মত নিজেরটা তাড়াতাড়ি শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়াল। সাথে সাথেই তার পাশে ছায়ার মত এসে দাঁড়াল সেই অপরিচিত মুখের ছেলেটি। নেশার আমেজে এবার সে হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। অপরিচিত ছেলেটিও খুব সাবলীলভাবে পিছু নিল।রাতের মেঘহীন আকাশে পূর্নিমার ঝকঝকে চাঁদ।ছড়ানো ছিটানো অল্পদুয়েক তারা। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় নিজের ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। খুব উত্তেজিত ভাবে সে আকাশে হাত উঁচিয়ে অচেনা ছেলেটিকে বলতে লাগল,
-ওই যে! আমার হৃদয় পৃথিবী ছেড়ে উড়ে গেল।একটা বেলুনের মত, দুরন্ত শকুনের মত।ওই যে!
ছেলেটির মুখও বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। সেও হাত উচিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে লাগল,
-হ্যা হ্যা। ঠিকই তো! ওই তো ঊড়ে গেল।
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×