মানব প্রজাতির আর্বিভাব
সাধারণতঃ ঐতিহাসিকগণ থৃীষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের আগের সময়কে ইতিহাসের আগের যুগ হিসেবে ধরে নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের মানবগোষ্ঠীর ইতিহাস লিথতে হলে বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর সর্ম্পকে কিঞ্চিৎ ধারণা বর্ণনার প্রয়োজন রয়েছে। মানবগোষ্ঠী বা মানুষ প্রজাতি জীবভূগোলের একটি উল্লেখযোগ্য এবং অন্যতম অংশ। জীবভূগোলের মাধ্যমেই আমরা মানুষ প্রজাতির বর্তমান বিস্তৃতির তথ্য অবগত হই এবং যার অন্যতম উপাদানই হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ। মানুষই একমাত্র প্রজাতি যার মধ্যে বিস্ময়কর বৈচিত্র বিদ্যমান। দেহের আকার-আকৃতি, মাথার আকার-আকৃতি, মুখের চেহারার বিভিন্নতা, চোয়াল, নাক, কান, ঠোঁট, চোয়ালের হাড়, চোখের উপরে ভূরুর পরিমাণ, মাথার চুলের রং, আকার-আকৃতি এ গুলো থেকে মানুষকে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়েছে। বিশিষ্ট নৃতাত্বিক ড. সি এস কুন এবং ড. এস কোল মানুষ প্রজাতিকে নিগ্রোয়েড,ককেশয়েড, মঙ্গোলয়েড,অস্ট্রোলয়েড, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী এবং আফ্রিকার জংলি মানুষ এই কয়েকভাগে ভাগ করেছেন। আবার অনেক নৃতাত্বিকরা বলেন যে মানুষ বা নরের সাথে মিল আছে এমন প্রাণী যেমন বানর, বনমানুষ,, গরিলা এদের মাথায় মগজের পরিমাণ খুব বেশী হলে থাকে ৬৫০ সিসি কিন্তু মানুষের মগজের আয়তন গরিলা বা বনমানুষের থেকে অনেক বড় এবং অনেক বেশী সক্রিয়। মানুষের মাথায় কমপক্ষে ১০০০ সিসি মগজ থাকে।
মানুষ সর্বপ্রথম কোথায় আর্র্বিভূত হয়েছে সে সম্পর্কে কিছুই বলা যায়না। জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরের কাছে নেয়ানড্যারথাল উপত্যকায় একটি মানুষের মাথার খুলি ও কিছু হাড় আবিস্কৃত হয়েছিল। পরবর্তীতে এ জাতীয় আরো অনেক কংকাল ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া যায়। যে সব এলাকায় এদের কবর পাওয়া যায় সেসব কবরে পাথরের অস্্রপাতি এবং খাবার হিসেবে মৃত জীবজন্তুর হাড়গোরও পাওয়া যায় তেজস্ক্রিয় অঙ্গারের সাহায্যে এসব কংকালের বয়স নির্ণয় করা হয়েছে এবং সবচেয়ে পুরানো যে কংকালটি পাওয়া গিয়েছে তার বয়স ধরা হয়েছিল ৩৪০০০ হাজার বছর। বিঞ্জানী চার্লস ডারুইন মনে করতেন, মধ্য-এশিয়া আদি মানবের জন্মভূমি। তাঁর মতে প্লাইয়োসিন যুগের প্রথম ভাগে মধ্য-এশিয়ার আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন আসে যাতে বৃক্ষচারী মানুষকে সমতল ভূমিতে বাস করতে নেমে আসতে হয়েছিল। কিন্তু মধ্য-এশিয়ায় আজ পর্যন্ত কোন আদি মানুষের কংকাল পাওয়া যায়নি। কোন কোন নৃবিজ্ঞানীর ধারণা যে ২৫০০০ থেকে ৪০০০০ বছর আগে নেয়ানডারথাল মানূষেরা পৃথিবীতে ছিল। নেয়ানড্যারথাল মানুষ যদি পরবর্তীতে আবহাওয়ার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় এসে থাকে তাতে অবাক হবার কিছু নেই কেননা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতেও এ জাতীয় মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার যব দ্বীপের ত্রিনিল এলাকায় মানুষের মাথার উপরিভাগ, কয়েকটি দাঁত ও একটি উরুর হাড় আবিস্কৃত হয়। এদেরকে নাম দেয়া হয়েছে ত্রিনিল মানুষ হিসেবে। ত্রিনিল মানুষের মাথার খুলির বয়স ধারণা করা হয়েছে ৫ লক্ষ বছরের। ত্রিনিল মানুষের পর বর্তমান চীনের রাজধানী বেইজিং ( পিকিং) শহরের তিনশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের কয়েকটি পাহাড়ের গুহা থেকে কয়েকটি কংকাল পাওয়া গিয়েছে। এদেরকে নাম দেয়া হয়েছে পিকিং মানুষ হিসেবে। বৈজ্ঞানিকরা নেযানড্যারথাল, ত্রিনিল এবং পিকিং মানুষকে বর্তমান মানুষের প্রজাতি ধারণা করেন। তবে এরা সবাই লুপ্ত মানব বলে গণ্য। অতি স¤প্রতি কানাডার ডটকম সূত্রে পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকায় সবচেয়ে প্রাচীন গুহামানবদের বাসস্থানের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। প্রজাতি হিসেবে আধুনিক মানুষের হোমো সেপিয়েন্স) প্রাচীন পূর্বসূরীরা সেখানে বাস করতো। খননের মাধ্যমে এখানে পাওয়া পাথরের হাতিয়ার বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন ২০ লক্ষ বছর আগে গুহাবাসী মানব এসব হাতিয়ার ব্যবহার করতো। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক চাজান এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। তাঁর সাথে জেরুজালেমের হিব্র“ বিশ্ববিদ্যালয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মেকগ্রেগর জাদুঘরের গবেষকরা জড়িত ছিলেন। গবেষকরা বলেন, এই গুহাবাসীরা ছিল প্রাইমেটভূক্ত (মানুষ, বানর, বনমানুষ,
লেমু প্রভৃতি এই শ্রেণীর অর্ন্তগত) প্রজাতির একটি হোমো হাবিলিস। ২০ লক্ষ বছর পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের বসবাস ছিল। তারা ছোট ছোট হাতিয়ার ব্যবহার করতো। ওনডার ওর্য়াক নামে একটি গুহার তলদেশে সেই হোমো হাবিলিসদের আবাসস্থলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এক বিবৃতিতে তাঁরা আরো বলেন, ভূতাত্বিক তথ্য প্রমাণে বোঝা যাচ্ছে গুহার মধ্যে আবিস্কৃত প্রাইরেট হাতিয়ারগুলো আমাদের পূর্বসূরিরা ফেলে গিয়েছে কিন্তু বাইরের কোন কারণে সেগুলো নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়নি।
মানব প্রজাতির আর্বিভাব সর্ম্পকে বিজ্ঞানীগণ কোন সুস্পষ্ট ধারণা এখনও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনাই বা সাহসী হয়নাই তার পেছনের অন্যতম কারণ বিশাল মানবগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাস। কিছু কিছু ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাস করা হয় আদম-হাওয়া অথবা এডাম-ইভকে ঈশ্বর নিজে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তৈরি করেছেন এবং তাঁর নির্দেশ ভঙ্গ করার অপরাধে বেহেশ্ত হতে পৃথিবীতে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। আবার সাঁওতালদের ধর্মীয় বিশ্বাসে বলা হয়, একটি বুনোহাঁস দু’টি ডিম পেরেছিল, সেখান থেকেই প্রথম মানব-মানবী পিচলু হরমু-পিচলু বুড়ীর জন্ম। আবার ধর্মীয় বিশ্বাসে বলা হয়, প্রথম মানব-মানবী আদম-হাওয়ার অনেক অনেক পরে পৃথিবী অন্যায়Ñঅনাচারে ভরে উঠেছিল এবং অন্যায় অনাচার দূর করতেই নূহ নবীর আর্বিভাব ঘটেছিল। তিনি অন্যায়কারীদের সৎ পথে আনার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ফলে এই অন্যায়-অনাচারীগণকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মহাপ্লাবন ঘটেছিল এবং অন্যায়-অনাচারীগণ সবাই মহাপ্লাবনে ডুবে মরেছিল। কেবল ন্যায়বানগণ নূহ-এর নৌকায় চড়ে বেঁচেছিল। পরবর্তীতে নূহের ছেলে হিন্দ্ক্ষে উপর পৃথিবীর এই অঞ্চল হিন্দুস্থান আবাদ করার দায়িত্ব পড়েছিল। তিনি তাঁর পুত্র বংকে হিমালয় এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানকে আবাদ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে বংগ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। ¦ বিশ্বের কোন স্থানে মানব প্রজাতি প্রথম আর্বিভূত হয়েছিল একমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন নির্ণয় করা এখনও সম্ভব হয়নাই। জীবভুগোলের সুত্র অনুযায়ী মানুষ যে প্রার্কতিক জীব বা প্রাণী তা মানুষ অনুভব করে কিন্তু সভ্য মানুষ তা স্বীকার করেনা। আদিম অনেক উপজাতি মনে করে, তারা কোন না কোন জন্তু থেকে জন্ম নিয়েছে। তাই এরা অনেক জন্তুকে খুব শ্রদ্ধা করে; শিকার করেনা বা খাযনা। ১৮৭১ সালে চার্লস ডারুইন তাঁর ডিসেন্ট অব ম্যান বইতে বোঝাতে চেয়েছিলেন মানুষের পূর্ব-পুরুষ মানুষ ছিলনা। মানব প্রজাতীর উদ্ভব হয়েছে ক্রমিক পরিবর্র্তনের মাধ্যমে। তাঁর মতে কোন লুপ্ত কোয়াদ্রুমানা হতে মানব প্রজাতীর উদ্ভব হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটি খুড়ে এমন অনেক লুপ্ত কোয়াদ্রুমানার অর্থাৎ নরবানরের মাথার খুলি ও হাড় পাওয়া গিয়েছে যার সাথে ডারুইনের লুপ্ত কোয়াদ্রুমানার ধারণার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এরাই যে ছিল মানুষের পূর্ব পূরুষ তা অনেকে মেনে নিতে পারেননি। ভারতের শিবালিক পাহাড় অঞ্চল থেকে একটি কংকাল পাওয়া গিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে সিভাপিথেকাস। অনেকের মতে ,এরাই মানুষের আদি পূর্ব-পুরুষ। নৃতাত্বিকরা তিনটি বিষয় বিচার করে মানুষের সংঞ্জা ঠিক করেছেন। প্রথমত যারা সোজা হয়ে দু’পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারতো; দ্বিতীয়ত যাদের মগজের পরিমাণ বর্তমান মানুষের কাছাকাছি; তৃতীয়ত তারা কমপক্ষে পাথর দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করতে পারতো।
সুদূর অতীতে পৃথিবীর আবহাওয়া বার বার খুবই শীতল হয়ে পড়তো। এইরকম সময়কে বিঞ্জানীরা নাম দিয়েছেন হিমযুগ। গত দশ লক্ষ বছরের মধ্যে প্রায় চার বার এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে। শেষবারের হিমযুগ শেষ হয়েছে প্রায় আট নয় হাজার বছর আগে। এরপর পৃথিবীর আবহাওয়া আবার গরম হয়ে উঠে, শুরু হয় নতুন বসন্ত। পৃথিবী হয়ে উঠে বনময়, সবুজ। নৃতাত্বিকরা ধারণা করেন যে নেয়ানড্যারথাল মানুষ যখন পৃথিবীতে ছিল তখনই শুরু হয়েছিল চতুর্থ হিমযুগ। এরা প্রথমে থাকতো সমভূমিতে। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে এরা চলে যায় পাহাড়ের গুহায়। নৃতাত্বিকরা বলেন যে এরা আগুন জ্বালাতে পারতো। মনে করা হয খুব অল্প সংখ্যক নেয়ানড্যারথাল মানুষ সম্ভবতঃ শেষ পর্যন্ত হিমযুগের হাত থেকে বেঁচেছিল। এখন
পর্যন্ত অনেক নৃতাত্বিকদের ধারণা যে বেঁচে যাওয়া নেয়ানড্যারথাল মানুষ থেকেই আধুনিক অর্থাৎ আমাদের মতো মানুষের উদ্ভব। প্যালেস্টাইনের কারমেল গিরিগুহায় যে নরকংকাল পাওয়া গিয়েছে তার সাথে আমাদের এবং নেয়ানড্যারথাল মানুষের মিল আছে। অনেকের মতে, অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের ভ্র“র হাড়, থুতনির হাড় নেয়ানড্যারথাল মানুষের মতো। (চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




