somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ "যোদ্ধা"

০২ রা ডিসেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেহেরু আর আমি একই ডিপার্টমেন্টের হওয়া সত্বেও ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো অনেক পরে......

মেয়েটা ছিপছিপে, হালকা পাতলা গড়নের ছিলো। ববকাট চুল। নিজে একটা মেয়ে হওয়া সত্বেও অন্য মেয়েদের সাথে ওর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে নি কেন জানি ! সম্ভবত মানসিকতা মিলতো না। ডিপার্টমেন্টের অধিকাংশ ছাত্রীই যেখানে পরচর্চা, সাজগোজ আর পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনাকে নিজেদের জীবনের লক্ষ্য করে নিয়েছিলো, মেহেরু সে জায়গায় ছিলো আশ্চর্য ব্যতিক্রম। আগেই বলেছি- সাজগোজ নিয়ে ওর তেমন মাথাব্যথা ছিলো না কখনোই। ঐ প্রজন্মের অনেকেই যখন হিমুর নায়িকা রূপা হওয়ার স্বপ্নে নীল শাড়ি পরে খোঁপায় রজনীগন্ধা গুঁজছে, মেহেরু তখন কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতো-

"দেয়াল লেখা থেকে বর্ণমালা
যদি আলোর মিছিল হয়ে যায়
টিএসসির মোড়ে রাতের রাজপথ
বুলেট কিংবা কবিতায়......"


অল্প সময়ের মধ্যেই অসামাজিক, কাঠখোট্টা আর 'এবনরমাল' মেয়ে হিসেবে মেহেরুর একটা ইমেজ দাঁড়িয়ে গেলো। তবে সমস্যা বেঁধেছিলো অন্য জায়গায়, একটু অন্যরকম হওয়ার কারণে ওর সম্পর্কে নানা গল্পও ডালপালা মেলেছিলো ক্যাম্পাসে। শুনলাম ও নাকি গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে। চেনা অচেনা অনেক পুরুষের সাথে ওকে দেখা যায় প্রায়ই। মেয়েটা সম্পর্কে এমন মুখরোচক খবর হলের আড্ডাতে চাঞ্চল্য যোগাতো। বন্ধুরা চোখ দিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা করতো একজন আরেকজনকে। রাহাত তো একদিন রাখঢাক না করে বলেই ফেললো - "ও তো একটা মাগী, জানস না !"

"যেই না চেহারা ! মাইয়ালোকের কিছুই তো নাই এর মধ্যে। এরে কেম্নে কি......"

রাহাতের কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে অনেকে। পাশ থেকে বাপ্পী আরো মসলাদার কিছু একটা যোগ করে।

ঐ আড্ডাতে আমিও ছিলাম। প্রথমে রাহাত, পরে বাপ্পির কথা শুনে সেদিন হেসেছিলাম আমিও। কিন্তু আমার চরম বিপদে এই রাহাত কিংবা বাপ্পি- কাউকেই পাশে পাই নি একসময়। বরং পেয়েছিলাম মেহেরুকেই ! আমার আব্বাকে যখন মিথ্যে মামলায় পুলিস ধরে নিয়ে গেলো, তখন আমার সেই বন্ধুগুলো আমার পাশে দাঁড়ায় নি। অনেকে তো ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে চলে গেলো। গভীর জলে ডুবতে ডুবতে চোখেমুখে যখন অন্ধকার দেখছিলাম, তখন অপ্রত্যাশিতভাবেই একদিন মেহেরুর ফোন এসেছিলো আমার মোবাইলে। হয়তো কারো কাছ থেকে আমার দুর্ভাগ্যের খবর জেনে থাকবে। সে আমাকে বললো- তাঁর হাইকোর্টে পরিচিত কিছু উকিল আছে। আমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে সে আমাকে ওঁদের চেম্বারে নিয়ে যেতে চায়......

আব্বাকে ততদিনে হাজত থেকে কেরাণিগঞ্জের জেলে চালান করে দিয়েছে। উনার জামিনের জন্য একজন ভালো উকিলের প্রয়োজন ছিলো খুব। মেহেরুর সহযোগিতায় সে উকিলের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। তিনি আব্বার মামলার নথিপত্র স্টাডি করে জানালেন- জামিন হতে একটু সময় লাগবে, তবে হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। আজ হোক কাল হোক জামিনের ব্যবস্থা তিনি করবেন।

কি যে অসহায় এক সময় পার করেছি সেটা বলে বোঝানো যাবে না ! সব থেকে অসহ্য লাগতো আব্বার সাথে দেখা করতে যাবার সময়। দু'মুখো সব অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতো ! আব্বার উপর রাগ হতো প্রচন্ড- ওনাকেই কেন এমন একটা কেসে ফাসতে হলো ! আবার একই সাথে মায়াও লাগতো প্রচন্ড । কখনো মনে হতো- কেউ আমাকে না দেখুক, পরিচিত সব মানুষগুলোর কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাই আমি। আবার কখনো কখনো ভাবতাম- আহা, কেরাণীগঞ্জ যাবার এই পুরোটা রাস্তা যদি কেউ আমার হাত ধরে একটু বসে থাকতো। কিছুটা সাহস দিতো কাঁধের উপর ভরসার স্পর্শ রেখে !

আমি ঠিক জানি না কেনো- হয়তো ততদিনে মেহেরুর প্রতি দুর্বল হয়ে গেছিলাম দেখে, অথবা ভরসা করার মত ওর এক সহজাত গুণ ছিলো তাই- একদিন আমি আমার এই অনুভূতির কথা মেহেরুকে জানিয়েছিলাম। এরপর থেকে আর একটা দিনের জন্যও ও আর আমাকে একা হয়ে যেতে দেয় নি। যতবার আব্বার সাথে দেখা করার জন্য গিয়েছি, ও আমার সাথে সাথেই ছিলো। নিজের অসহায়ত্ব, দুর্বলতা আর মানসিক চাপ সইতে না পেরে যখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতাম, তখন মেহেরু আমার পাশে বসে রইতো মুখ গোমড়া করে। ঐ একজনই। আর কেউ না ! আমাকে বলে নি কখনো- "ছিঃ সাখাওয়াত ! ছেলেদের এভাবে কাঁদতে হয় না !"

এই কেরাণীগঞ্জ যাওয়া-আসার পথেই মেহেরু আমাকে ওর নিজের গল্প বলতো মাঝে মাঝে। ওরা এলাকার কয়েকজন মিলে ধর্ষিতা মেয়েদের সহযোগিতার জন্য একটা উদ্যোগ দাঁড়া করেছিলো। নির্যাতিতা মেয়েগুলোকে আইনী সহায়তা দেয়া থেকে শুরু করে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট কিংবা সামাজিক পুনর্বাসন- এ সবই ফ্যাসিলিটেট করার চেষ্টা করতো ওরা। মূলত এ উদ্যোগের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই সমাজের নানা শ্রেণী, নানান পেশার মানুষের সাথে উঠবস শুরু করে মেহেরু। এভাবেই আসলে একদিন ভিক্টিমের পরিবার কিংবা নিকটাত্মীয়দের খুব বড় একটা ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিলো সে আর তাঁর ঐ উদ্যোগ; ক্যাম্পাসের ছেলেপিলেরা তাঁকে একেকদিন একেক পুরুষের সাথে দেখতো বলে যে একটা প্রচারনা সবার মাঝে ছড়িয়ে গেছিলো, তার প্রেক্ষাপট আসলে এই ! আসলে ঐ পুরুষদের সবাই ছিলো ধর্ষিতা কোনো না কোনো মেয়ের সাহায্যপ্রার্থী বাবা, নয়তো ভাই ! যে সমস্যার কথা সমাজের আর আট/দশজনকে মুখ ফুটে বলা যায় না, সেটা নিয়েই তাঁরা মেহেরুর কাছে চলে আসতেন পরম নির্ভরতায়, আর মেহেরু তাঁদের নিয়ে ছুটতো কোনো উকিল নয়তো ট্রমা সেন্টারের খোঁজে......

আমি মেহেরুকে কথায় কথায় একদিন বলেছিলাম, ওর সম্পর্কে অনেক আজেবাজে ধারণা প্রচলিত আছে। "আমি নিজেও তোমার সাথে এতো ঘনিষ্ঠভাবে না মিশলে কখনো বুঝতে পারতাম না...... আসলে...... " তারপর ইতস্তত করে বললাম- "মেহেরু, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে ! যে তোমার পায়ের ধুলি হওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই, সেই আমি কি না তোমার সম্পর্কে শোনাকথার বিপরীতে কখনো কোনো প্রতিবাদ করি নি !" তারপর একটু থেমে বললাম- "একটা সুযোগ কি আমাকে দেয়া যায় ? প্লিজ ?"

সম্ভবত দোষ স্বীকারের এই সৎ প্রবণতা আর নিজেকে সংশোধনের প্রবল প্রতিজ্ঞা দিয়ে আমি মেহেরুর হৃদয় জয় করেছিলাম। যদিও ওর সম্পর্কে প্রচলিত মত তেমন করে পাল্টাতে পারি নি কখনো, কিন্তু আজেবাজে কিছু শুনলেই প্রতিবাদ করতাম। বলতাম- "মেহেরু মোটেও এমন নয়। ওর মত সৎ আর উন্নত চরিত্রের মেয়ে খুব কমই আছে আসলে ! প্লিজ না জেনেশুনে একটা মানুষ সম্পর্কে এমন বাজে মন্তব্য ......"

তবে সত্যি বলতে মেহেরুকে নিয়ে আমার ভয় ছিলো অন্য জায়গায় । ভিক্টিম মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে করতে ও অনেকের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলো। কয়েকজন টাকাওয়ালা, প্রভাবশালীও ছিলো ওর মধ্যে। কেরাণীগঞ্জ থেকে আসার পথে এক জায়গায় একটা কাশবনের মত পড়ে। মন খুব খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে আমি ওখানে নেমে যেতাম। সাথে মেহেরুও। বনের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিচু গলায় বলতাম- "তুমি ওদের সাথে লড়াই করে পারবা না। এসব মানুষের হাত অনেক লম্বা হয়, জানো ! টাকা দিয়ে ওরা সব কিনে নিতে পারে। সব ......"

মেহেরু তখন চোয়াল শক্ত করে, অথচ শান্ত গলায় বলতো- "আমার দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা । তাঁর উত্তরসূরী হয়ে আমার এসব পরোয়া করলে চলে না !"

কোমল কাশফুলের মৃদু হেলদোলের বিপরীতে মেয়েটার এই কাঠিন্য বড় বেমানান লাগতো আমার কাছে। অনেকটা কালবোশেখীর মত। একই সাথে ভয়ংকর এবং সুন্দর !

ওর দাদার পরিচয়টা অবশ্য আমি আগে থেকেই জানতাম। আরো জানতাম মেয়েটা কিশোরী বয়েসেই তাঁর মা'কে হারিয়েছে। পিতা আর একমাত্র ছোটভাইকে নিয়ে ওদের সংসারটা অগোছালো হলেও চলে যাচ্ছিলো কোনোরকম। বাবা অসুস্থ থাকায় আর আগের মত কিছু করতেও পারতেন না তেমন, স্রেফ ছোট্ট একটা ফ্রিজ, টিভি সারাইয়ের দোকান ছিলো তাঁর। সব মিলে অল্প বয়স থেকেই মেহেরু সংসারের অনেক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলো আসলে। পার্ট টাইম কি যেনো একটা সেলাইয়ের কাজও করতো।


এরকম কত কথা, নিজেদের কত সুখ-দুঃখের গল্প আমরা বিনিময় করে করে পার করেছি কেরাণিগঞ্জ থেকে ঢাকা অথবা ঢাকা-কেরাণিগঞ্জ যাওয়ার পুরোটা রাস্তা ! আমি বুঝতে পারছিলাম, মেহেরুর প্রতি আমার নির্ভরতা শুধু বাড়ছেই দিন কে দিন। অবশ্য আমিও ততদিনে মেহেরুর খুব ভালো একজন বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। কেননা ওর পরিচিত অসংখ্য মানুষ থাকলেও বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিলো না আসলে। মেয়েদের সাথে ওর বনতো না- আগেই বলেছি, আর ছেলেরা যেমন আহ্লাদী, সুন্দর চেহারার মেয়ে খুঁজে বেড়ায় সাধারণত- মেহেরু কোনোদিক দিয়েও অমন কেউ ছিলো না কখনো। একদিন আমার এমনকি এটাও মনে হলো- মেহেরু বুঝি বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে । তীব্র ভালোবাসা মানুষকে দুর্বল করে। মেহেরুকেও করেছিলো তার প্রমাণ আমি একদিন পেলাম......


ততদিনে আমার আব্বার জামিনের আদেশটা হাতে পেয়ে গেছি, শেষবারের মত দেখা করতে গেছিলাম জেলে আব্বার সাথে। ভেতরে ভেতরে খুব উৎফুল্ল থাকায় ঐদিন মেহেরুর মনোভাব অত খেয়াল করি নি। করলে বুঝতাম ও একটু অপ্রতিভ ছিলো সে সময় কোন একটা কারণে। কেরাণীগঞ্জ থেকে ফেরত আসার পথে অবশ্য ওদিনও কাশবনটাতে নামলাম। খুশি খুশি গলায় মেহেরুকে বলেছিলাম- "চলো, আজ তোমাকে নাজিরাবাজারে খাওয়াবো। ওখানকার মতির বিরানিটা ভালো......"

মেহেরু অল্প হাসলো একটু। কিছু বললো না।

"তোমার কি কিছু হয়েছে মেহেরু !"

"নাহ, তেমন কিছু না ! আচ্ছা সাখাওয়াত, মানে ...... আমি যদি কখনো মারা যাই, তুমি কি আমাকে মনে রাখবে !"

আমি, সেই প্রথম, এবং শেষবারের মত মেহেরুর চোখে পানি দেখলাম। তাও সেটা ঝিকিমিকি উল্কার মত। ক্ষণিক টলমল করেই আবার বাষ্প হয়ে উড়ে গেছিলো নিমিষে। আমি মেয়েটার হাত ধরে শক্ত গলায় বলি- "কি হয়েছে আমাকে ডিটেইল একটু বলো তো !"

শুনলাম কোন এক শিল্পপতি নাকি একটা রেপ কেসে ফেঁসে গেছিলো সম্প্রতি। ভিক্টিম মেয়েটাকে সব ধরণের সাহায্য সহযোগিতা করছে মেহেরু, তাই সব রাগ গিয়ে ওর উপর পরেছে। ওকে নাকি মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে ঐ শিল্পপতির লোকজন। কেস থেকে সরে না আসলে মেহেরুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে ওরা।

ঐদিন আর নাজিরাবাজারে খেতে যাওয়া হয়নি আমাদের। ঢাকা আসার সারাটা রাস্তা আমি মেহেরুর হাত ধরে রইলাম। আর মনে মনে বলছিলাম- আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও যেনো ওর জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। তবে বাইরে অবশ্য ভাব দেখালাম ভিন্ন। যেনো কিছুই হয় নি টেনশন করার মত ! শান্ত গলায় ওর শেখানো কথাই সেদিন আমি ওকে ফেরত দিয়েছিলাম- "মেহেরু, তুমি একজন যোদ্ধার বংশধর । এসব হুমকিতে তোমার এভাবে ভয় পাওয়াটা মানায় না !"

মেয়েটা আমার কথা শুনে একটু হাসলো। নীচু গলায় বললো- "আমি সারাজীবন এমন কাউকেই সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিলাম, যে আমার মনোবলের উৎস হবে। যার যত্নে-আলোয়-পানিতে আমি এক নাজুক লজ্জাবতীর বদলে হয়ে উঠবো কোনো সাহসী বট ! তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাই সাখাওয়াত, তুমি মিথ্যার সাথে আপোষ করে, ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আমার সাথে হাজার বছর বাঁচতে চাও নি ! বরং তোমার আমার সম্পর্ক মুহূর্তের জন্য হলেও তা ভরে উঠতে পেরেছে সত্য, ন্যায় আর আলোয় ......"

কেনো জানি না, মেহেরুর এ কথাটুকু শুনে আমার চোখে পানি এসে গেছিলো হঠাৎ। আমি দ্রুত বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
***

মেহেরু খুন হয় এর পরের মাসে। খুব কাছ থেকে নাকি ওর মাথা আর বুকে দু'টো গুলি করা হয়েছিলো। অসংখ্য মানুষ সমবেত হয়েছিলো ওর জানাজার নামাজে। এগুলো সবই অবশ্য শোনা কথা, কারণ মেহেরুর দাফনের দিন আমি কেরাণিগঞ্জ চলে এসেছিলাম। কবরস্থান বা ওর বাসা পর্যন্ত যাই নি। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো ওদিন সারাটা বিকেল জুড়ে। আশ্বিন মাসে সাধারণত এমন বৃষ্টি হয় না। আমি ভিজতে ভিজতেই মৃতপ্রায় কাশবনের ভেতর দিয়ে একাকী হেঁটে বেড়ালাম। অল্পক্ষণেই অবশ্য বৃষ্টি কেটে গিয়ে চমৎকার রোদ উঠেছিলো। মেহেরুর বদলে আমাকে এসে স্পর্শ করলো পড়ন্ত বিকেলের নরম নরম আলো । সর্বশেষ মেয়েটা ধবধবে সাদা এক কামিজ পরে আমার সাথে নেমে এসেছিলো এখানে। সে-ই যে, জামিনের আগে আব্বার সাথে যেদিন শেষ দেখা করলাম- ঐদিন ! কাশফুলের সাদার সাথে মেয়েটার শুভ্র জামা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিলো। আমার মেহেরুর বিষণ্ণ কন্ঠস্বর মনে পড়লো- "সাখাওয়াত, ভুলে যাবা না তো কখনো ... !"

দূ--র প্রান্তরে নীল কুয়াশার মত অন্ধকার নামে। ওদিককার শহরপ্রান্তে দেখতে পাই রাতের আলোরা সব জ্বলে উঠছে কেমন একের পর এক। আচমকা বাতাস এসে কাশফুলের বনটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। আমার স্পষ্ট মনে হতে থাকে- এই বনেই কোথাও বুঝি মেহেরুর পালকের মত শরীরটা আড়াল হয়ে আছে। সে তো আমার চরম দুঃসময়েও আমাকে ছেড়ে যায় নি কখনো, তবে আজ কেনো যাবে ! নিশ্চই অল্প খুঁজলেই পাওয়া যাবে তাঁকে ! মনের ভেতর থেকে কে যেনো কথা বলে ওঠে- তাড়াতাড়ি খোঁজো সাখাওয়াত, সময় বেশি নেই আর ! সময় খুব কম !

আমি চোখভর্তি পানি নিয়ে পুরো কাশবন পাগলের মত খুঁজে বেড়াই। হালকা-পাতলা গড়নের ফড়িঙের পাখনার মত এক মেয়ে, ছোট করে ছাটা চুলে যাকে দেখাতো আপোষহীন এক যোদ্ধার মত। কালবোশেখির সৌন্দর্য আর রুদ্রতা সে একই সাথে ধারণ করেছিলো শরীরে, কিন্তু হৃদয়ে শুধু মায়া। আমার ভীষণ খারাপ লাগে, আমি কান্না সামলাতে সামলাতে কাশবন ওলট পালট করি অবুঝ শিশুদের মত......

শুনতে পাই সে একই কন্ঠ আমার মাথার ভেতর বিড়বিড় করে বলছে-

"......চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার ;

এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়না'কো আর।"

***
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×