somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষা সবকিছু বদলে দেয়

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নোবেল পুরস্কারজয়ী অমর্ত্য সেনের জন্ম ৩ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে। ১৯৯৮ সালে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। অমর্ত্য সেন বর্তমানে থমাস ডব্লিউ লামোন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। এডিনবরায় কমনওয়েলথের এক শিক্ষা সম্মেলনে তিনি মৌলিক শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ক এ বক্তৃতাটি করেন।কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষা-সংক্রান্ত এ সম্মেলনে কথা বলতে পারছি বলে নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করছি। এ সম্মেলনের জন্যে এডিনবরাকে বেছে নেওয়ায় আমি খুবই খুশি। শিক্ষার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে আয়োজিত এ সম্মেলনের জন্যে এডাম স্মিথ, ডেভিড হিউম এবং বিখ্যাত শিক্ষাবিদদের স্মৃতিবিজড়িত এডিনবরার চেয়ে উত্তম স্থান আর কী হতে পারে?প্রশ্ন হচ্ছে, কেন শিক্ষাগত বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন? কেন শিক্ষার সুযোগ, শিক্ষা অর্জন, শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির মধ্যে বৈষম্য থাকবে? পৃথিবীতে পক্ষপাতহীন একটি পরিবেশ তৈরি করতে আমাদের এ বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এইচ জি ওয়েলসের ভাষায়, মানব ইতিহাস ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে শিক্ষা ও বিপর্যয়ের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতায়। যদি আমরা এভাবেই পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার কক্ষপথ থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে রাখি, তবে পৃথিবী হয়ে যাবে অপেক্ষাকৃত কম নিরাপদ, ন্যূনতম ন্যায়পরায়ণতার পৃথিবী। এইচ জি ওয়েলসের বিংশ শতকের চেয়ে আজকের পৃথিবী এখন আরো অনেক অনিশ্চিত। ৯/১১-এর বিভীষিকা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে অগণন মানুষের মৃত্যু মানব জীবনকে আরো অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। শুধু সন্ত্রাস ও সহিংসতাই মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কারণ নয়। সহিংসতায় যত মানুষ মারা যায়, এইডস রোগে তার চেয়ে কম মানুষ মারা যায় না। মানুষের নিরাপত্তাহীনতা নানাভাবেই তৈরি হতে পারে, সন্ত্রাস ও সহিংসতা তার অন্যতম কারণ মাত্র।সন্ত্রাসবাদ কিংবা গণহত্যা প্রতিরোধ করতে চাইলে আমাদের এই মানব-নিরাপত্তাহীনতার বহুমুখি প্রকৃতি এবং প্রকাশিত রূপগুলি মেনে নিতে হবে। যেহেতু এটা ঘটছে, সেহেতু সকল ধরনের নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে মৌলিক শিক্ষার প্রসার এবং ফলপ্রসু প্রচারই শক্তিশালী প্রতিরোধী ভূমিকা রাখতে পারে। সারা পৃথিবীতে এই নিরাপত্তাহীনতা হ্রাস করতে সকল ধরনের বৈষম্য এবং অবহেলাকে দূর করতে হবে যেখানে মৌলিক শিক্ষার ভূমিকা বিবেচনা করা জরুরি।নিরক্ষরতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব নিরাপত্তাহীনতার দুটি রূপ। যে পড়তে, লিখতে, গুনতে কিংবা যোগাযোগ করতে পারে না, সে সবচেয়ে বড় বৈষম্যের শিকার। এভাবেই তাঁর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার মানসিকতা গড়ে ওঠে। সফলভাবে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ যদি ব্যক্তির নাগালে পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে তা হবে এই বৈষম্য দূর করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ, এ নিরাপত্তাহীনতাই পৃথিবীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, সংঘর্ষের সূচনা করে।মৌলিক শিক্ষা জীবনকে সহজভাবে দেখতে শেখায়। অসম্ভব দরিদ্র পরিবারগুলোও এ বিষয়টি ভালোভাবে বোঝে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দরিদ্র ও বঞ্চিত পরিবারগুলি শিক্ষাকে কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তা দেখে আমি অভিভূত হয়েছি।ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে দেখা গেছে সফলভাবে প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের মধ্য দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কীভাবে কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কারের পুরো অর্থ দিয়ে আমি তৈরি করেছি ‘প্রতীচী ট্রাস্ট’, যার লক্ষ্য ভারত ও বাংলাদেশে মৌলিক শিক্ষা এবং লিঙ্গ সমতায়নকে ত্বরান্বিত করা।আমি দেখেছি, কেন মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে অনাগ্রহী হয়। স্কুলের খরচ, নিরাপত্তাসংকট এবং আরও অনেক সামাজিক বাধা তাদের স্বপ্ন পূরণে দেয়াল তৈরি করে। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা স্কুলে না পাঠানোর বড় একটি কারণ। এ বাধাগুলো দূর করতে হবে। তবে আরও অনেক বাধা আছে, মেয়েদের নিরাপত্তা ও ছেলেমেয়ের শ্রমের ওপর দরিদ্র পরিবারের নির্ভরতাও স্কুলে না পাঠানোর জন্য দায়ী। পাঠদানের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিষয়টি জানাতে হবে যাতে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি দূর করা সম্ভব হয়। মানুষের নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে আমাদের পাঠদানের গুরুত্ব বুঝতে হবে। মৌলিক শিক্ষা মানুষকে চাকরি পেতে এবং অর্থসংস্থানে সাহায্য করে। শিক্ষার সাথে অর্থনৈতিক এ সম্পর্ক বিশ্বায়নের এ যুগে খুব জরুরি। এগুলো কিন্তু আমাদের সমাজের নিরপত্তাহীনতারই স্বরূপ। তাই মৌলিক শিক্ষার সম্প্রসারণ করা দরকার। এটি তাদের দারিদ্রের সমাপ্তি টানার ক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখাবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষাপ্রাপ্তির সঙ্গে তাদের যে বিশাল শূন্যতা, একে পূরণ করতে হবে। মেইজি স্থাপনের পর জাপানে ১৮৭২ সালে ‘মৌলিক শিক্ষার কোড’ প্রচলন করা হয়। প্রচার করা হয়, কোনো সম্প্রদায়ে একটিও অশিক্ষিত পরিবার থাকবে না, কোনো পরিবারে একজনও অশিক্ষিত ব্যক্তি থাকবে না। শিক্ষা বৈষম্য দূর করার মধ্য দিয়ে আজ জাপান এ শতকের একটি অন্যতম দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দেশ। ১৯১০ সালে সেখানে অনেক দরিদ্র মানুষ ছিল। এরপর জাপান ব্রিটেনের চেয়েও অধিক বই ছেপে গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে দ্বিগুণ বই প্রকাশ করেছে। আজ তার ফল সুস্পষ্টভাবেই দেখা মেলে।বিংশ শতকের মধ্যভাগে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান, হংকং এবং সিঙ্গাপুরসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ প্রত্যেকেই এভাবে তাদের উন্নয়নের পথটি তৈরি করেছিল। শিক্ষার প্রসারই একে সহজ করেছে। বিশ্বব্যপী অর্থনীতিতে তাদের অংশ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। কারণ, তাদের জনগণ আজ লিখতে ও পড়তে পারে, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা তৈরি করতে পারে, নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারে। অশিক্ষা মানুষকে তার আইন অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, দেশ গঠন ও স্বাস্থ্যগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। অশিক্ষার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরা। নারীরা তাদের অধিকার, প্রাপ্তি, সম্পদের মালিকানা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, তেমনি সমাজে প্রকট বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অবিচার ও অন্যায় আচরণ। গবেষণায় দেখা গেছে, কীভাবে ন্যূনতম সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নারীদের শিক্ষা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ত্বরান্বিত করে, যার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার সঙ্গে নারীর এই দুরত্বকে দূর করা। বন্ধুতা এবং বিশ্বস্ততা নির্মাণে হোক কিংবা স্বাধীনতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারেই হোক, এসব ক্ষেত্রে মৌলিক শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর জন্য প্রয়োজন, একদিকে যেমন শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সকলের জন্য সহজলভ্য করে দেওয়া, অন্যদিকে শিশুদের বিভিন্ন অঙ্গনের জ্ঞানের ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দেওয়া। তারা যেন জিন্তা করতে পারে, কারণ অনুসন্ধান করতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের উৎ সাহিত করা দরকার। মৌলিক শিক্ষা যে শুধু দক্ষতা বৃদ্ধির আয়োজন করে তা নয়। এটি প্রাকৃতিক পৃথিবীর সাথে একাত্ম করে মানুষকে। তার মনকে করে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রপূর্ণ। বুঝিয়ে দেয় স্বাধীনতা, যুক্তি ও বন্ধুত্বের গুরুত্ব।
গার্ডিয়ান-এর আর্কাইভ (২০০৩) থেকে পাওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর: শিখ্তী সানী
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×