আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়িতাম, বয়স তেরো কী চৌদ্দ। আমাদের বিদ্যানিকেতনটি অবস্থিত ছিল প্রত্যন্ত এক গ্রামে, আমাদের বাড়ি হইতে প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার দূরে। প্রত্যেহ হাঁটিয়া, লুঙ্গি পরিয়া বিদ্যানিকেতনে যাইতাম।
একদিন বিদ্যানিকেতনে গিয়া শুনি উথুরা বাজারে ডাকাত ধরা পড়িয়াছে (উথুরা আমাদের ইউনিয়নের নাম, তৎসংলগ্ন বাজারকে উথুরা বাজার বলা হয়)। সহপাঠীদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য-উৎফুল্লতা দেখা দিল। আমি কখনও ডাকাত দেখি নাই, বয়স অল্প- স্বভাবতই আমিও সবার সঙ্গে ডাকাত দেখিতে চলিলাম।
নারাঙ্গী চৌরাস্তা হইতে নারাঙ্গী বাজার (নারাঙ্গী আমাদের গ্রামের নাম), নারাঙ্গী বাজার হইতে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখিলাম, রাস্তায় একখানি মাইক্রোবাস দাঁড় করানো আছে। রাস্তা-ঘাট সব বদ্ধ! কোনো প্রকার গাড়ি চলাচল করিতে পারিতে ছিল না। মাইক্রোবাসের ভিতরে উঁকি দিয়া তালাবদ্ধ একখানি বৃহৎ ট্রাঙ্ক দেখিলাম, ওইখানেই ছিল লুণ্ঠিত সব টাকা; পাশেই কিছু মিষ্টান্নের প্যাকেট। ডাকাতেরা টাকা লুণ্ঠনের খুশিতে বোধহয় মিষ্টান্ন কিনিয়াছিল। আফসোস, তাহাদের মিষ্টি খাওয়ার সুযোগ হয় নাই।
রাস্তার বাম পাশে কয়েকজন পুলিশ গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করিতেছিলেন। একটু সম্মুখে আগাইলাম। লোকমুখে শুনিলাম, অনন্যোপায় হইয়া বাম পাশের পথটি ধরিয়া ডাকাতেরা পালাইতে চাহিয়াছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখে পথ শেষ হইয়া গিয়াছে। ওইটা যে অসম্পূর্ণ পথ, অচেনা ডাকাতেরা কী করিয়া চিনিবে? অতঃপর মাইক্রোবাস হইতে নামিয়া যে যাহার মতো দৌড়াইয়া পালাইতেছিল। ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হইয়াছিল যে, গ্রামে ডাকাত পড়িয়াছে। ঘোষণাটি অতি দ্রুত রাষ্ট্র হইয়া যায়। লোকজন ডাকাতদের কয়েকজনকে ধরিয়া ফেলে। তাহার পরের কাহিনী অত্যন্ত করুণ।
লোকজন যাহাদিগকে ধরিয়াছিল, একজনকেও বাঁচিতে দেয় নাই। বাঁশ দিয়া পিটাইয়া পিটাইয়া হত্যা করিয়াছে। একজন কর্দমাক্ত ধানখেত ধরিয়া পালাইতেছিল, লোকজন তাহাকে ধানখেতেই পুঁতিয়া রাখে, একজনের মাথার মগজ গলাইয়া ফেলে, একজনের অণ্ডকোষ পিষাইয়া দেয়, একজনের চক্ষু খুলিয়া ফেলে। জনৈক গৃহস্থের অনুকম্পায় একজন অবশ্য বাঁচিয়াছিল, পুলিশ আসিয়া পড়ায় আরও একজনকে জেলা পরিষদের এক কক্ষে বন্দী করিয়া রাখা হয়।
উথুরা বাজারে গিয়া দেখি মৃতদেহগুলো সারি সারি করিয়া ট্রাকে সাজানো হইয়াছে। যেন রক্ত-মাংসের স্তুপ! মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কী করিয়া হয়? লাশগুলোর দিকে চক্ষু বুলাইয়া স্থির থাকিতে পারিলাম না, সঙ্গে সঙ্গেই নামাইয়া রাখিলাম। এমন বিকৃত চেহারা আমি কখনও দেখি নাই।
ডাকাতেরা ময়মনসিংহ শহরের সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখা হইতে এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকা লুট করিয়া ঢাকা অভিমুখে ফিরিতেছিল। অকস্মাৎ পুলিশ তাহাদের পিছু নেয়। ত্রিশাল অতিক্রম করিয়া ভরাডোবা আসিয়া ভরাডোবার ভিতর দিয়া সাগরদীঘির দিকে পালানোর চেষ্টা করিয়াছিল ডাকাতেরা। উথুরার সন্নিকটে আসা মাত্রই উত্তেজিত জনতা লাঠিসোটা হস্তে রাস্তায় নামিয়া আসে, শাল কাষ্ঠ ফেলিয়া রাস্তা অবরোধ করিয়া রাখে।
আশ্চর্যের কথা এই, পর্যাপ্ত অস্ত্র বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তাহারা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করিবার সুযোগ পায় নাই। দৌড়াইয়া পালাইতে গিয়া মার খায়। বিপদে পড়িলে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়। এইখানে তাহাই যেন হইল। তাহারা যদি জনতার সম্মুখে একখানি গ্রেনেড ছুড়িয়া মারিতে পারিত, জনতা প্রাণের ভয়ে দৌড়াইয়া পালাইত।
মান-অভিমান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ভয়ে হউক, আর থানা-হাজতের ভয়েই হউক; মৃতদেহগুলো শনাক্ত করিতে কাহারও কোনো আত্মীয়-স্বজন থানায় আসে নাই। ভালুকায় খিরু নদীর উপর নির্মিত ব্রিজের নিচে ডাকাতদের শবদেহ পুঁতিয়া রাখা হয়। মুর্দাদের মধ্যে দুই জন মন্ত্রীর পুত্রও নাকি ছিল।
২৫ কার্তিক ১৪২২ বঙ্গাব্দ
ময়মনসিংহ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ১:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




