অষ্টম শ্রেণিতে উঠিয়া জানিতে পারিলাম আমাদিগকে বোর্ডিংয়ে যাইতে হইবে। বিদ্যানিকেতনের সঙ্গেই একটি কক্ষে বসবাসের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। আমাদের সঙ্গে থাকিবেন দশম শ্রেণির বড়ো ভ্রাতারা। বিদ্যানিকেতনের নিকটেই যাহাদের বসবাস, তাহাদিগকেও যাইতে হইবে। সুতরাং, কাহারও মাফ পাওয়ার সুযোগ নাই। শিক্ষার্থীদের ভালো ফল করার নিমিত্তে বোর্ডিংয়ে যাওয়া একরকম বাধ্যতামূলক হইয়া গেল। ঠেলার নাম বাবাজি! অনিচ্ছা সত্ত্বেও যথাসময়ে আমিও বোর্ডিংয়ে উঠিয়া গেলাম।
বোর্ডিংয়ে উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই নানাবিধ বিপত্তি আসিয়া বাঁধিল। রাত্রি বারোটা অবধি পড়িতে হইবে। পড়া সম্পন্ন না হইলে আরও এক ঘণ্টা অর্থাৎ রাত্রি একটা অবধি জাগরণ। আমি কখনও রাত্রি দশটা পাড় করিতে পারি নাই। বারোটা-একটার উপরে কী করিয়া জাগিব ভাবিয়া খুব চিন্তায় পড়িয়া গেলাম।
প্রত্যেহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িতে হইবে। না পড়িলে বেত্রাঘাত! সে যাহাই হউক, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া প্রচণ্ড রকম বিরক্তিকর হইয়া দাঁড়াইল। বিশেষ করিয়া ফজরের নামাজের জন্য জাগ্রত হওয়া অসহ্য রকম যন্ত্রণাদায়ক ছিল। না উঠিতে চাহিলে মৌলবী মশাই পিটাইয়া তুলিতেন। মনে মনে বলিতাম, “খোদার আর কর্ম নাই? আমরা নামাজ পড়িলে তাহার কী লাভ, আর না পড়িলেই কী? বান্দাকে কষ্ট না দিয়া কি তিনি শান্তি পান না?”
জানিয়াছি, খোদা নাকি পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম দিয়াছিলেন। মুসা নবির উছিলায় তাহা পাঁচ ওয়াক্তে আসিয়া নামিয়াছিল। মনে মনে ভাবিতাম, “তা-ও ভালো মুসা নবি ছিলেন, নইলে তো আমাদের বারোটা বাজিত।”
নামাজ পড়িতে পড়িতে একসময় বিরক্ত হইয়া একটি নিয়তও বানানো হইয়াছিল সেইসময়। তাহা নিম্নরূপঃ “নাওয়াইতো আন উছাল্লির চালা, মানে মালেক স্যারের বাপের ভিটা; গুইজ্জা আম্বাইরা বাড়ি, স্যারদের ডরে নামাজ পড়ি- আল্লাহু আকবার।”
একসময় রমজান মাস আসিয়া গেল। মৌলবী মশাইয়ের কড়া নির্দেশ সবগুলো রোজা রাখিতে হইবে। পাক্কা ত্রিশটি রোজা! বাপরে বাপ! ঝামেলার যেন একশেষ। ন্যায়বিচারক আল্লাহপাক নাকি সারা বছরই রোজা রাখার নির্দেশনা দিয়াছিলেন। নূরের নবি মোহাম্মদ এই ফরমান লইয়া ফিরিতেছিলেন। এইবারও ত্রাণকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হইলেন মুসা নবি । তাঁহার উছিলায় রোজা ত্রিশটিতে নামে। মাঝে মাঝে মনে হয়, “মানুষ যদি সারা বছরই রোজা থাকিত, তাহা হইলে কী করিয়া বাঁচিত?” কী কারণে ঠিক জানি না, টানা বারো বৎসর ত্রিশ রোজা রাখিয়াছিলাম।
সেইদিন ছিল চন্দ্রিমা রাত্রি। একেবারে ভরা পূর্ণিমা! চারিপাশ আলো ঝলমলে। কিছুতেই পড়ার টেবিলে আমার উদাস মন টিকিতে ছিল না। তাই ঘর ছাড়িয়া আমি বাহিরে চলিয়া আসিলাম। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, চন্দ্রের আলোয় স্নান করা- যাহাকে বলে চন্দ্রস্নান । একটি ছোট্ট বেঞ্চি লইয়া চন্দ্রিমার আলোয় চুপিসারে বসিয়া রহিলাম। আহা! কত সুন্দর সে-ই চন্দ্রের আলো! লন্ঠন নিভাইয়া চন্দ্রের আলোয় অধ্যয়ন করিতে লাগিলাম। সব কিছু স্পষ্টতই দেখা যাইতেছিল। সেই রাত্রিটির কথা অদ্যাপি আমার মনে পড়ে।
আমি কখনও সিনেমা হলে সিনেমা দেখি নাই। বড় ভ্রাতারা অকস্মাৎ ঠিক করিলেন, সিনেমা হলে সিনেমা দেখিতে যাইবেন। তাহারা আমাকেও প্রস্থাব দিলেন। আমি সহাস্যে রাজি হইয়া গেলাম। তাহাদের সঙ্গে রওয়ানা দিলাম, যদিও মনে মনে ভয় করিতেছিল। মৌলভী মশাই যদি জানিতে পারেন; তাহা হইলে আর রক্ষা নাই।
প্রথম সিনেমা দেখার স্মৃতি সুখকর ছিল না। সিনেমার নাম “অ্যাকশন লেডি”। মেয়েরা প্রথমে অত্যাচারিত হয়, পরে সব অনাচারের প্রতিশোধ নেয়। তখন অশ্লীল সিনেমার সময়। সিনেমা হলে আপত্তিকর সব সিনেমা চলিত। কিছু কিছু রগরগে দৃশ্যের সময় নিচে চক্ষু রাখিতে হইল। বয়স অল্প ছিল, ঐসব ধর্ষণ অথবা অন্তরঙ্গ দৃশ্য হজম করিবার সময় না!
ফিরিতে ফিরিতে রাত্রি হইয়া গেল। আমরা সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হইয়া ছিলাম। মালেক স্যারের সঙ্গে যদি দেখা হইয়া যায়, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই (এই স্যার সাক্ষাৎ যমদূত ছিলেন। হরহামেশাই আমাদের বেত্রাঘাত করিতেন কারণে-অকারণে)। সেইদিন অবশ্য কপাল ভালো ছিল। স্যার কোনো এক কারণে এলাকার বাহিরে গিয়াছিলেন।
দিনে ঘুমানো হয় নাই। বারোটা-একটা অবধি জাগরণ সম্ভব না! বড়ো ভ্রাতারা তখন সিগারেট ফুঁকিতেছিলেন। আমরা বন্ধু-বান্ধবরা মিলিয়া সিগারেট ফুঁকিবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিগারেট ফুঁকিলে নাকি নিদ্রা চলিয়া যায়! আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। দুই-এক টান দিতেই কাশিতে কাশিতে গলা চিরিয়া যাওয়ার অবস্থা হইল। সিগারেট ছুড়িয়া ফেলিলাম।
বোর্ডিং থেকে স্থানীয় বাজার খানিক দূরে ছিল। তৈল ফুরাইয়া গেলে বাজারে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। শিক্ষকগণ মাঝে মাঝে শ্রেণিকক্ষে উঁকিঝুঁকি দিতেন। পাঠ্যরত অবস্থায় কাউকে না দেখিতে পাইলে পরবর্তীতে তাহাকে বেধড়ক উত্তম-মধ্যমে দিতেন।
অতি কঠোর নিয়ম মানুষকে বিপথগামী করে। ছেলেদের মধ্যে কিছু খারাপ অভ্যাস সৃষ্টি হইয়াছিল। কেউ কেউ তৈল চুরি করিত। এই নিয়া একাধিকবার সালিশও বসিয়াছিল, কিন্তু চোর ধরা পড়িতে ছিল না। এই অবস্থা হইতে পরিত্রাণের নিমিত্তে ভুক্তভোগী দুষ্ট ছেলেরা বোতলে নিজেদের মূত্র জমা করিতে লাগিল। কেউ কেউ (যাহারা চুরি করিত) ভুলবশত তাহা লন্ঠনে ভরিয়াছিল। একসময় এইসব ঘটনা অবশ্য ফাঁস হইয়া যায়। আমি নিজেও একবার এই কর্মে লিপ্ত হইয়াছিলাম। বিচার হইয়াছিল আমার। বড় ভ্রাতারা আমার পক্ষে ছিলেন বিধায় শাস্তি মওকুফ হইয়াছিল।
এমন সব আরও কত ঘটনাই যে সেইসময় ঘটিয়াছিল, আজ আর সব কিছু স্মরণে নাই। তিন-চারি মাস বোর্ডিংয়ে ছিলাম। পরীক্ষার ফলাফলের অগ্রগতি তেমন হয় নাই, যদিও দৈনিক আট-দশ ঘণ্টা করে পড়িয়াছি। বাড়িতে চারি ঘণ্টা আর বোর্ডিংয়ে দশ ঘণ্টা সমানই বোধ হইল। আসলে শিক্ষকদের আড়ালে অনেকটা সময় চলিয়া যাইত গল্প-গুজবেই!
একসময় সেই নরক যন্ত্রণা হইতে মুক্তি ঘটে। পরবর্তীতে অবশ্য দশম শ্রেণিতে উঠিবার পর আরও একবার বোর্ডিংয়ে গিয়াছিলাম, সে-ই স্মৃতি সুখকরই ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১২:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




