somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার শিক্ষক জীবনের আনন্দ-বেদনার গল্প

১২ ই নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক বছরের উপর মালিবাগের টিউশনিটা করিয়েছি। বাসা বদল করার কারণে কয়েকমাস হলো বাদ দিয়েছি। মহাখালী থেকে মালিবাগ গিয়ে পড়ানো সম্ভব হয় না। লিঙ্করোড হয়ে গেলে যাওয়া-আসায় ২ ঘণ্টা পার। সাতরাস্তা-মগবাজার হয়ে গেলে যানজট। মাঝেমধ্যে যেতেই ২ ঘণ্টা! আবার পড়ানো ২ ঘন্টা৷ বেতন দেয় মাত্র ৪ হাজার টাকা। পোষায় না, তাই বাদ দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।

হঠাৎ টিউশনি বাদ দিতে চাওয়ায় বাচ্চাদের মা অবাক হয়েছিলেন। আমি তো হুটহাট টিউশনি বাদ দেওয়ার মতো লোক না। আমি উনাকে বলতে পারছিলাম না, এত অল্প টাকায় চলছে না আমার। আমাকে অন্য রাস্তা দেখতে হবে, উপার্জন বাড়াতে হবে। যদিও উনি জানতেন আমি বাসা বদল করেছি। আসা-যাওয়ার খরচ আছে। সময়ও যায় অনেক।

যখন ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছিল, তখন সব বলতেই হলো। আমি কেন ২ ঘণ্টার উপর পড়াই, সেটাও বললাম। কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলে হয়তো মালিবাগেই থাকা যেত। এখন তো সে উপায় নেই। উনি বললেন, “আগে জানালে ভালো হতো।”

প্রতিটা মানুষের কাছেই সময় খুব মূল্যবান। একজন গৃহশিক্ষক যখন বেশি সময় পড়ান, তার প্রত্যাশা থাকেই ‘কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলে ভালো হতো’। সেটা হয়তো সরাসরি বলা যায় না। এমন হতো তারা অভাবী। সেক্ষেত্রে টাকা বাড়ানো নিয়ে জোরাজোরি নেই। বাচ্চারা ভালো স্কুলে পড়ছে। আরও টিউশনির খরচ চলছে। সংসারের সব খরচ চলছে, অথচ বেগার খাটানো শুধু নির্দিষ্ট একজনকে!

সেটাও কথা না। সবসময় যে টাকার জন্যই পড়াই, তাও না। মনের টানেও পড়াই। বহুদিনের অভ্যাস তো। মায়া পড়ে গেছে। এখনও মনে হয়, বড়ো অঙ্কের টাকার চাকরি পেলেও টিউশনি করাব অথবা ভালো স্কুল পেলে শিক্ষকতা করব। মনের টানেই পড়াই আর যে কারণেই পড়াই। আমাকেও তো খেতে হয়, পরতে হয়, পরিবারের কথা ভাবতে হয়। নিজের দুঃখের কথা বাদ। ভালোবাসার টানে পড়ালেও দিনশেষে তো পরিবারের কথা ভাবতে হয়। সবই বলে এলাম আসার সময়। এটাও বলে এলাম, শিক্ষক পেতে সমস্যা হলে জানাবেন। উনি জানাবেন বলে মনে হলো না। কারণ, উনি কিছু টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন। আমি রাজি হইনি।

মাসখানেক পর যখন বাচ্চাদের দেখতে গেলাম, উনি জানালেন শিক্ষক রেখেছেন। পড়ালেখা ভালোই চলছে। তবে আমার মতো ৬-৭ দিন পড়ান না সপ্তাহে। ৫ দিন পড়ান। গুনে গুনে ২ ঘণ্টা করে। বললাম, “সবাই তো আর আমার মতো বোকাসোকা না!”

উনি হেসে বললেন, “আপনি বোকাসোকা কে বলল? মানুষ হিসেবে অত্যাধিক সৎ আপনি। আমার বোন থাকলে বিয়ে দিতাম।”

আমি বললাম, “এমন গরিব ঘরের ছেলের কাছে কেউ মেয়ে/বোন বিয়ে দেওয়ার কথা না।”

আমি চলে আসার পর উনি অনেকদিনই ফোন দিয়েছেন। আমি যেন তাদের বাসায় যাই। সময় সুযোগ হয় না৷ তাছাড়া সঙ্কোচও লাগত আমার। মানুষ আসলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে জানে না। উনি যখন বারবার যেতে বলতেন; এ প্রবাদটা মনে পড়ত শুধু।

এমন ব্যাপার মুগদার মাধ্যমিকে পড়ুয়া মেয়েটার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। কয়েকমাস পড়িয়েছি। মালিবাগ থেকে পড়াতে যেতাম। সারা মাস পড়িয়ে পেতাম দুই হাজার টাকা। বাস ভাড়া চলে যেত ৫০০। আসলে এত অভাব ছিল যে, না পড়িয়ে উপায়ও ছিল না৷ আরেকটা কোচিংয়ে পড়িয়ে তো সারা মাসে ৬ হাজার পেতাম। প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা করে কোচিং করিয়ে মাস শেষে ৬ হাজার!

মুগদার মেয়েটা এ+ পেয়েছিল; এ কথা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়েছিল। অবশ্য ফল পাওয়ার আগেও সে মেসেজ দিত। আমি তো মন খারাপ করে যোগাযোগ রাখিনি অনেকদিন। কারণ, আমার কাছে মনে হতো অন্য শিক্ষকদের তুলনায় আমি খুব অবহেলিত। মাঝেমধ্যে বাসায় গিয়ে ফেরতও আসতে হয়েছে। একদিন অন্য শিক্ষক এসেছেন, অন্যদিন বেড়াতে যাবে- এসব কাণ্ড ঘটছিল। আমাকে আগে থেকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করত না।

একদিন হঠাৎ মেসেজ পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। জিগ্যেস করেছিলাম, “আমার কথা এখনও মনে আছে?” সে বলেছিল, “আপনার মতো শিক্ষক হয় না। মানুষ হিসেবেও আপনি অসাধারণ।” ব্যাপারটা আমি জানতাম না অবশ্য। শহুরে আধুনিক আবার ভালো একজন ছাত্রী যখন এমন প্রশংসা করেছে, তাহলে সত্যিও হতে পারে।

যাক সে কথা। সেদিন হঠাৎ ফোন দিল মালিবাগের ছাত্রীর বাসা থেকে। গেলাম, পড়ালামও ঘণ্টা দুই। পিচ্চি মেয়েটা, যাকে একদিন মেরেছিলাম, সে পড়তে বসল। যে মেয়েকে তেরো মাস পড়িয়ে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ শেখাতে পারিনি, এবিসিডি শেখাতে পারিনি, এক-দুই শেখাতে পারিনি; সে এখন সব পারে। লিখতে দিলাম, সব লিখল।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি, তার গালে লাল একটা দাগ। “কীসের দাগ, আন্টি?”

তার ৪র্থ পড়ুয়া বোন বলল, “স্যার, তার দাঁত পড়েছে।” আমি বললাম, “সত্যি নাকি?” সে বলে, “জি, স্যার।”

আমি বলি, “আন্টি আপনি তো আমার মায়ের বয়সি। এত পড়ালেখা কেমনে পারেন?”

ওর মা বলে, “ওই যে একদিন মারলেন। এরপর থেকে তো পড়ত প্রতিদিন। তাছাড়া আপনি যেভাবে শিখিয়ে গেছেন, সেভাবেই পড়ছে। আমি দেখাই।”

এখনকার শিক্ষক কোথায় জানতে চাইলাম। উনি বললেন, “বাদ দিয়েছি।”

বাচ্চাদের বাবার সাথে দেখা হয়েছিল রাস্তায়। উনি বলেছিলেন নতুন টিচার তেমন পড়াতে পারেন না, তাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চার মাকে বললাম, “নতুন টিচার রাখেননি?”

উনি বললেন, “একমাসের জন্য আর কী টিচার রাখব? আপনি যদি সময় দেন সপ্তাহে একদিন ভালো হতো।”

“একদিন পড়িয়ে কী এমন হবে?” আমি বলি।

“যতটুকু হয়।” রাজি হই অবশ্য। এতদিন পড়িয়েছি; একটা দরদ আছে না? টাকা-পয়সা লাগবে না বলি। বাচ্চার বাপ বিরক্ত হন। “বিনে পয়সায় পড়াবেন কেন?”

আমি বলি, “৪ সপ্তাহে আর কত দেবেন? আচ্ছা, মন চাইলে যা খুশি দেবেন।”

ছবি: ইন্টারনেট

আরও পড়ুন: ১) বেলা, অবেলা ও কালবেলাঃ টিউশন
২) ছিল মর্মবেদনা ঘন অন্ধকারেঃ কোচিং এর গল্প
৩) গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুলে অতিবাহিত করা যৌবনের উত্তাল সাড়ে ছয় মাস একদিন
৪) আমি ধর্ষক নই, প্রেমিক হইতে পারি বড়জোর
৫) মোহভঙ্গ
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২৪ সকাল ৯:০৫
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×