কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন। এটা তো উত্তর হলো না। আমরা ৪০-৪৫ জন যাত্রী; এরমধ্যে নারী-শিশুও আছে। আমাদের ভোগান্তিতে ফেলার কারণ কী?
এরমধ্যে আরও কয়েকজন পুলিশ এসে হাজির হলেন। তারা বললেন, গাড়ির রিকুইজিশন লাগবে। আমাদের কিছু করার নেই। এটা সরকারি ডিউটি।
আমরা বললাম, রূপান্তর পরিচিত পরিবহণ। আপনারা ওদের ফোন নম্বর রাখুন। আমাদের গুলিস্তান রেখে আসুক অথবা আপনাদের দু-একজন আমাদের সঙ্গে চলুন। যাত্রী নামানোর পর গাড়ি নিয়ে চলে আসবেন।
পুলিশ নাছোড়বান্দা। কারও কথা শুনল না। ৯৯৯ এ ফোন দেওয়া হলে তারাও জানাল এটা পুলিশের ডিউটি। পালন করতেই হবে। পুলিশের দায়িত্বপরায়ণতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমন পুলিশই তো চাই আমরা।
ধর্ষণ হলে আসামি ধরতে পারে না, টাকা খেয়ে আসামি ছেড়ে দেয়। অথচ আবাসিক হোটেলে রেড দিয়ে যুবক-যুবতীদের আটক করে তারা বিরাট দায়িত্ব পালন করে। কোনো হত্যাকাণ্ড হলে কেউ বাদী হয়ে মামলা না করলে স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু করে না। বলে, মামলা করা হলে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
যাহোক, অন্য একটা গাড়িতে আমাদের উঠিয়ে দেওয়া হলো। ওই গাড়ির যাত্রীরা জিগ্যেস করলেন ঘটনা কী? বিস্তারিত শুনে বললেন, আমাদেরটাও আটক করেছিল। আট হাজার টাকা খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
২
কেউ ঘুস খেয়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে, বিদেশে অর্থপাচার করেছে- এমন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কারও বাড়িতে হামলা হয়েছে এমন কখনও শোনা যায়নি (আদালত অনেককে শাস্তি দিয়েছেন বটে, তবে বেশিরভাগই পার পেয়ে যায়)। তবে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দিয়েছে- এমন অভিযোগ তুলে অনেকের ওপর হামলা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর লুটপাট করা হয়েছে।
রোজা রেখে কিছু খেলে আল্লাহ দেখে ফেলবেন; এই ভয়ে রোজা ভাঙে না অথচ চুরি-দুর্নীতি ঠিকই করে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়, পণ্যে ভেজাল দেয়- সংসারে এমন মানুষের অভাব নেই। যারা বিশ্বাস করে রিজিকের মালিক আল্লাহ, এমন মানুষও মেয়ে-বোন-ভাগ্নি বিয়ে দেওয়ার সময় ভালো ছেলের পরিবর্তে টাকা-পয়সাওয়ালা ছেলের খোঁজ করে।
যে সারাজীবন আকাম-কুকাম করেছে, শেষ বয়সে এসে হজ করে ধর্মকর্মে মন দিলে অনেকের কাছে সাত খুন মাফ হয়ে যায়। অন্যের বউকে ভাগিয়ে নিয়ে গেলে, শিশু নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও কোনো দোষ থাকে না। তার পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকের অভাব পড়ে না। ধর্ম তাকে চারদিক দিয়ে রক্ষা করে।
৩
শচীন টেন্ডুলকার নরমাল ডেলিভারিতে আউট হলে আমরা অনেকেই বাহাস করেছি, বলেছি, এমন বলে কেউ আউট হয়? কেউ অসুস্থ হলে চারপাশে শুধু ডাক্তার আর ডাক্তার। এ এই পরামর্শ ও ওই পরামর্শ। পরামর্শের ঠেলায় জীবন ঝালাপালা। ডাক্তারকেও পরামর্শ দেওয়ার ঘটনাও আছে।
আমরা চারুকলায় পড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরমাণু নিয়ে গবেষণা চাই, আমাদের এখানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলে পড়ুয়ারা ধর্ম বিশারদ হয়। যে যে বিষয়ে পড়েনি, সে বিষয়ে পাণ্ডিত্য জাহিরে আমাদের জুড়ি নেই। সব জান্তার দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ।
সমাজে যা প্রতিষ্ঠিত, আমরা সে সবেরই সাফাই গাই। সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল হলেও তা এমনভাবে ধরে রাখার প্রচেষ্টা, মনে হয় মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ। অথচ হওয়ার কথা ছিল ঠিক উল্টো। আমাদের আইনকানুন, আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজব্যবস্থা আমাদের কতটুকু মানবিক করে তুলছে; সে প্রশ্নটা তোলার সময় এসেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৩:০৪