somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গুলতেকিনের দুঃখ এবং আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তরুণ শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন গুলতেকিন। তখন হুমায়ূনের বয়স ২৫ বছর (জন্ম ১৯৪৮ সাল), আর গুলতেকিন সবে কৈশোরে উপনীত হয়েছেন। অর্থাৎ, তিনি তখন অপ্রাপ্তবয়স্কা। বয়সের সীমাবদ্ধতা বুঝে উঠার আগেই আবেগ আর মুগ্ধতার বশবর্তী হয়ে ঝোঁকের মাথায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।

হুমায়ূন আহমেদ তখন নবীন শিক্ষক, তবে তার সাহিত্য প্রতিভা এরইমধ্যে অনেককেই আকৃষ্ট করেছিল। লেখার জগতে তিনি ছিলেন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি, যাকে ভালো না বাসা কঠিনই ছিল। গুলতেকিনও তার লেখার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় পাওয়া যায়, গুলতেকিন তার অফিসে চলে যেতেন এবং গল্প-গুজবে সময় কাটাতেন। বিয়ের পর অবশ্য সেই কল্পনার হুমায়ূন আর বাস্তবের হুমায়ূনের পার্থক্য টের পান তিনি। তবুও দীর্ঘ ২৭ বছর তারা একসঙ্গে ছিলেন—শেষমেশ ২০০৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।

এর পর হুমায়ূন আহমেদ বিয়ে করেন অভিনেত্রী ও গায়িকা মেহের আফরোজ শাওনকে। গুলতেকিন জানান, সম্পর্ক রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি।

২০১২ সালের জুলাইয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ততদিনে তাঁর খ্যাতি দেশজুড়ে। হুমায়ূন-গুলতেকিনের সংসারে তিন মেয়ে—নোভা, শীলা, বিপাশা এবং এক ছেলে—নুহাশ।

বিচ্ছেদের পরও গুলতেকিন খান মাঝেমধ্যে লেখালেখির মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। তাঁর লেখায় উঠে আসে এক নারীর নিঃশব্দ কষ্ট, ত্যাগ আর অভিমান। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, হুমায়ূন আহমেদের শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন নিরব সহযাত্রী, কিন্তু নিজের জীবনের কঠিন সময়ে সেই সহায়তা পাননি তিনি। হুমায়ূন সবসময় নিজের জগতে ব্যস্ত থাকতেন—বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতেন, কিন্তু পরিবারকে সময় দিতেন না।

গুলতেকিন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার, কিন্তু বাল্যবিবাহ সেই স্বপ্নে বাধা দেয়। পরে তিনি পড়াশোনা আবারও শুরু করেন। আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি সম্পন্ন করে হলি ক্রস কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু অভিযোগ অনুযায়ী, পরীক্ষার আগেই হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে জোর করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। ফলে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে বহু কষ্টের পর ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তিনি হুমায়ূন আহমেদের নানার বাড়ি নেত্রকোণার মোহনগঞ্জের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন এবং অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৮৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরুতে সমাজ বিজ্ঞানে ভর্তি হলেও বিষয় পরিবর্তন করে পরে ভর্তি হন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন। পরে ১৯৯৮ সালে স্কলাসটিকা স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

বিচ্ছেদের পর গুলতেকিন একা হাতে সন্তানদের মানুষ করেন। এর মধ্যে সন্তানদের সঙ্গে হুমায়ূনের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। ২০১৯ সালে, বিচ্ছেদের প্রায় ১৬ বছর পর, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আফতাব আহমেদের সঙ্গে নতুন করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন গুলতেকিন। জানা যায়, আফতাব আহমেদের আগের বিয়েটিও বহু আগে ভেঙে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে হুমায়ূন আহমেদ এক অনন্য নাম—জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই লেখকের শাওনকে বিয়ে করার পর সেই জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমে যায়। মানুষ তাঁকে সমালোচনায় বিদ্ধ করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—অল্প বয়সে বিয়ে বা বিবাহবিচ্ছেদ কি সমাজে নতুন কিছু?

না, মোটেও না। তবুও কেন এত সমালোচনা? হয়তো গুলতেকিনের ত্যাগ, তার দীর্ঘ সময়ের সঙ্গ এবং সেই সম্পর্কের ভাঙন মানুষকে ব্যথিত করেছিল বলেই।

আসলে সম্পর্ক টিকে থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া ও সময়ের বিনিময়ে। অনেক সময় ভালোবাসা থাকলেও বাস্তবতা কঠিন হয়। ভালো লাগা সবসময় একরকম থাকে না। জীবনানন্দের ভাষ‍ায় বলতে হয়, ‘প্রেম ধীরে মুছে যায় নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’। সবসময় ত্যাগ করলেই যে সম্পর্ক টেকে এমন না, জীবনে রঙবদল ঘটলে অনেককিছুই উলটপালট হয়ে যায়। তখন একসাথে থাকলে যদি তিক্ততা বাড়ে, তবে বিচ্ছেদই হয়তো একমাত্র শান্তির পথ।

বিয়ে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত—যা হুট করে নিলে পরে আফসোসের কারণ হতে পারে। যেখানে দেখেশুনে করা বিয়েও টেকে না, সেখানে আবেগের বশে করা বিয়ে কতটা স্থায়ী হতে পারে?

আমাদের সমাজে এখনও অনেকেই একই ভুল করছেন—চেহারা, খ্যাতি বা বাহ্যিক আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করছেন, অথচ মানসিক মিলের বিষয়টি উপেক্ষা করছে। তারপর দেখা যায়, ভাঙন। এই প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

ছবি ও তথ্যসূত্র

এ সম্পর্কিত আরেকটি লেখা- দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চরি (হুমায়ুন-গুলতেকিন প্রসঙ্গ)

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটা সংশে‍াধনে চ্যাটজিপিটির কিছুটা সহযে‍াগিতা নেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৫৯
১৩টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×