somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কমল বাওয়ালি উপাখ্যান..........

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চারিদিকে ঘন বন, আকাশ ছোয়া কড়াই, সেগুন, জাম, গর্জনের সমারোহ। নীচে গোলপাতা ঝোপের পাশ দিয়ে ছোট ছোট খাল বয়ে চলছে আঁকাবাকা সরিসৃপের মতন। কাছেই ভৈরব নদী কিন্তু তার তীর যেতে সাধারন মানুষ কেই সাহস পায় না, কারণ ওখানেই সাহেবদের নীলকুঠি।
সেই ঘন বনের মধ্যে কিশোরী কমল আর তার বাবা করিম বাওয়ালী মধু আর গোলাপাতা সংগ্রহ করছে ঘুর ঘুরে। করিম বাওয়ালী এই এলাকার একজন পেশাদার মধু ও গোলপাতা সংগ্রহকারী। বন থেকে এসব সংগ্রহ করে তুলে দেয় মহাজনের হাতে বিনিময়ে যে টাকা পায় তা দিয়ে ভাল ভাবেই কাটছিল বাবা মেয়ের জীবন। কিন্তু তাদের এই সুখ বেশিদিন রইলো না, কিছুদিন আগে নীলকর বেনি সাহেবের লোকজন ঢেরা পিটিয়ে ঘোষনা দিয়েছেন সবাইকে নীলচাষ করতে হবে, যারা করবে না তাদের জন্য কঠিন শাস্তি!
করিম বাওয়ালী বাপদাদার পেশা মধু ও গোলপাতা সংগ্রহকরা, এই পেশা সে কিছুতেই ছাড়বে না। তার উপর নীল চাষে কোন লাভও নেই। এই কারনে সে মেয়েকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে বনে, গভীর রাতে ঘরে ফেরে নীলকর বেনী সাহেবের ভয়ে। নীলকর রেনী সাহেবের অত্যচারে মানুষের জীবন একদম ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে।


সুন্দরবনের ভেতরে গ্রামের স্কেচ। এটি একেছিলেন লেয়ার ফেড্রিক পিটার (১৮১৮-১৮৯১)
সেদিন বড় একটা গাছ থেকে মৌ এর চাক ভাংছিল তারা, বাবা উপরে আর মেয়ে কমল নীচে দাড়ানো। এমন সময়ে ঘোড়ার পদশব্দে চমকে উঠলো তারা, বুঝতে কষ্ট হল না অত্যাচারী রেনী আসছে। ভয়ে চতুর্দশ বর্ষীয়া কমল এতটুকু হয়ে গেলো। তারাতারি করিম বাওয়ালী গাছের উপর থেকে মেয়েকে গোলপাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ার ইশারা করলো, আর নিজে গাছের আরও উপরে ঘন পাতার আড়ালে চলে গেল।
কিছুক্ষনের মধ্যের রেনী সাহেবের ঘোড়া এসে থামলো গাছের গোড়ায়, কমল পালিয়ে যাবার সময়ে ভুলে মধু সংগ্রহরে সরঞ্জাম নিতে ভুলে গিয়েছিল, সেটা চোখে পড়ে গেলো তার। সতর্ক দৃষ্টিতে উপরের দিকে তকাতেই চোখ পড়লো ভয়ার্ত করিমে বাওয়ালির দিকে। ঘোড়ার উপরের বসেই শাই শাই করে শূন্যের চাবুকের আঘাত করে করিম বাওয়ালীকে নীচে নামার আদেশ দিলেন তিনি।

নাম কি তোমার?
করিম বাওয়ালী।- ভয়ার্তকন্ঠ বাওয়ালীর
কুঠির খাতায় নাম লিখিয়েছিলে?-সক্রোধ দৃষ্টি রেনী সাহেবের।
না হুজুর!
আর কোন প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করলো না রেনী সাহেব, শপাং শপাং চাবুকের আঘাতে ককিয়ে উঠলেন করিম বাওয়ালি, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।
বাবার এই অবস্থা দেখে গোলপাতার আড়ালে আর লুকিয়ে থাকতে পারলোনা কিশোরী কমল। সুন্দরবনের বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে বর্শাটা সে সাথে রাখতো সবসময়ে, সেটাই সর্বশক্তি দিয়ে আকড়ে ধরে লাফিয়ে এসে পরলো রেনীর সামনে। এই আতর্কিত হামলার জন্য রেনী প্রস্তুত ছিল না, কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই কমল বর্শাটা ছুড়ে দিল রেনীর বুকের দিকে লক্ষ করে। তবে রেনী ভাগ্যভাল যে সেটা বুকে না লেগে বাহুতে লাগলো, যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠলো সে।
অতো কিছু খেয়াল করার সময় নেই কমলের; সে তার বাবা দুজনে মিলে রেনীর চাবুকটা দিয়েই পেচিয়ে তাকে বেধে রেখে তার ঘোড়ায় করে গহীন অরন্যের দিকে হারিয়ে গেলেন।

তারপর?

ইতিহাসে রেনীর অত্যাচারের কথা উল্লেখ থাকলেও কমল আর তার পিতার কোন উল্লেখ নেই। খুলনার লোক মুখই শুধু সাহসী কমলের নাম শোনা যায়। বর্তমান খুলনার দেড় মাইল উত্তর পূর্বে ভৈরব নদীর দক্ষিনে রেনীগঞ্জ নামে একটা জায়গা আছে, যা এই নীলকুঠীর অত্যাচারী রেনী সাহেবের নামেই হয়েছিল।
যাক সে কথা; স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুযায়ী কমল আর তার বাবা পরে সুন্দর বনের দস্যু দলের সাথে যোগ দেয়। এই দস্যুরাদের বেশীর ভাগই ছিল নীলকর সাহেবেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী। ১৮৩১ সালে তিতুমীর এর বিদ্রোহী দলে খুলনা শত শত লাঠিয়াল কিষান যোগ দিয়েছিলেন, তিতুমীরের মৃত্যুর পরে এরা সুন্দরবনে আত্মগোপন করে। সুযোগ বুঝে এরা নীলকরদের আস্তানার হানা দিয়ে ধনসম্পদ লুঠ করতো, বরিন হুডের মতোন তাই না?
এদের দলেই ভীরে যায় কলম আর তার বাবা।
লোককথা অনুযায়ী এই দস্যু দল কমল কে মহাসন্মানে তাদের দলে স্থান দিয়েছিল, বিভিন্ন অভিযানে কমল অংশ নিতে থাকে। সেই সময়ে সে ছেলেদের মতো পোষাক পড়তো, বর্শা আর তলোয়ার চালানোতেও সুনিপুন হয়ে উঠেছিল।
এরপরে তিতুমিরের একজন অনুচর সৈয়দজানের সাথে কমলের একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সেই সময়ে সুন্দরবনের কাছে একটা সরকারী থানা ছিল, সেখানে প্রচুর অস্ত্র আর সৈন্য মওজুত থাকতো বিদ্রোহীদের দমনের জন্য। এক গভীর রাতে কমল আর সৈয়দজানের দল এসে হানা দিল থানায়, উদ্দেশ্য অস্ত্র লুঠ করা। থানার সরকারী সৈন্য আর বিদ্রোহীদের সাথে ভীষন যুদ্ধ হয়, মানুষের আর্ত চিৎকারে নাকি তখন ঐ অঞ্চলের বন্য জন্তু পর্যন্ত বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে গিয়েছিল!!
অনেক অস্ত্র বিদ্রোহী দস্যুদের হাতে আসে, কিন্তু এই যুদ্ধু কমল বাওয়ালী নিহত হয়েছিলেন।



না এসব কোন কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই, খুলনা জেলার অধিবাসীরাই মুখে মুখে এই গল্প বলে থাকে।না থাক ইতিহাসের পাতায়; তবে তাদের সেই বিদ্রোহ কিন্তু থিতিয়ে যায় নি, দিনে দিনে সুন্দরবনের দস্যুরদের আক্রমন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এদেশে বহু বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকার দমন করতে পারলেও সুন্দরবনের দস্যুদের দমন করতে পারেনি। তাদের দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার এদেশের প্রথম মহাকুমাটি খুলনাতেই স্থাপন করেছিল। অনেকে বলেন চন্ডীকাব্যের নায়ক ধনপতির স্ত্রী খুলনার নামে থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল খুলনা। সে যাই হোক খুলনা শহর মূলত নয়াবাদ নামক স্থানেরই পর্ববর্তী নাম, বন কেটে নতুন বসত তাই নয়া বসত।
ধীরে ধীরে আবাদি জমি বাড়তে বাড়তে বন যখন বঙ্গোপসাগরের দিকে সঙ্কুচিত হচ্ছিল তখন স্বদেশী দস্যুরাও বনের গভীরে না যেয়ে ধীরে ধীরে জনপদে মিশে যেতে লাগলো।
খুব বেশি দিন আগের কথা কিন্তু না, বাংলার বিপদ-সংকুল এক বন্য অজপাড়াগায়ে মাত্র চতুর্দশ বর্ষীয়া যে বাওয়ালি মেয়েটি সর্বপ্রথম নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল তার কথা ইতিহাসে লেখা না থাকলেও খুলনার মানুষের মুখে আর অন্তরে আজও সে স্মরনীয় হয়ে আছে।


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:০৬
৮৭টি মন্তব্য ৮৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×