somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশু" এবং এক অসহায় অনুচ্চারিত ইতিহাস....সময় হবে কি দেখার?

১৫ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিশ্বের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে দেখা যায় যেকোন জাতিকে দমন করার জন্য, নির্মূল করা জন্য দুটি অস্ত্র এক সাথে ব্যবহার করা হয়েছে; গণহত্যা এবং অপরটি ধর্ষন।
১৯৭১ সালে পাকি বাহিনী তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সাহায্যে ঠিক এই কাজটাই করেছিল বাংলাদেশে।
একাত্তুরে এদেশের নারীদের উপর যৌন নির্যাতননের ব্যপকতা, নৃশংসতা এ যাবতকালে বিশ্বে সংগঠিত সকল যৌন নির্যাতনের শীর্ষে। এই নির্যাতন ছিল সুপরিকল্পিত, তারা বাঙ্গালীদের ধর্ষনের মাধ্যমে এক নতুন জাতির সৃষ্টি করতে চেয়েছিল যাতে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ আর কোনদিন মাথা তুলে না দাড়াতে পারে। সম্প্রতি জেনারেল খাদিম হুসাইন (২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারী) ১৯৭১ সাল নিয়ে এক আত্মকথনে লিখেছেন .......
"১০ এপ্রিল একটি সভায় জেনারেল নিয়াজি উপস্থিত। সেখানে তিনি অকথ্য ভাষায় বাঙালিদের গালিগালাজ করতে লাগলেন এবং এক পর্যায়ে উর্দুতে বললেন, 'ম্যায় ইস হারামজাদি কওম কি নাসাল বদল দুন গা। ইয়ে মুঝে কীয়া সামাঝতি হ্যায়'(আমি এই হারামজাদা জাতির চেহারা বদলে দেবো, এরা আমাকে কি মনে করে)"

নিয়াজির এই উক্তিতে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্তান আর্মি বাঙালিদের ;চেহারা বদলের' সুযোগ লুফে নেয়। আর এর জন্য সহজ রাস্তা ছিল বাঙালি মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তাদেরকে দিয়ে সাচ্চা মুসলমান বাচ্চা পয়দা করানো।
যুদ্ধকালীন সময়ে সারা দেশের ৪৮০ টি থানা থেকে গড়ে প্রতিদিন ২ জন করে নির্যাতিত মহিলার সংখ্যা অনুসারে ২৭০ দিনে ধর্ষিতার নারীদের সংখ্যা দাড়ায় ২ লক্ষ। আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস,যুদ্ধের পরপরই তিনি এসব মা ও তাদের শিশুদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন তাঁর মতে এই সংখ্যা আরও বেশি এবং সেটা ৪ লক্ষ।

এই নির্যাতন কোন তাৎক্ষনিক ঘটনা বা সৈনিকদের জৈবিক চাহিদার বিষয় ছিল না, আগেই বলেছি এটা ছিল সুপরিকল্পিত এবং সেই সাথে যোগ হয়েছিল প্রবল বিদ্ধেষ ও প্রতিহিংসা। এই বিদ্ধেষ নারীর প্রতি না, সমগ্র বাঙালী জাতির প্রতি বিদ্বেষ। এবং এই হিংসার অমানবিক ছাপ তারা রেখে গিয়েছিল বাঙলার ধর্ষিতা নারীদের উপর।
পাকি ক্যাম্প গুলোতে আটক নারীদের উপর অত্যাচারের যে বিবরন প্রতক্ষদর্শীগন দিয়েছেন তা এতই অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম যে সেটা কোন মানুষ মানুষের সাথে করতে পারে বলে মনে হয় না........

'পাশবিক ধর্ষন শেষে এই নির্যাতিতা মেয়েদের হেড কোয়াটারের উপরের তলার বারান্দায় মোটা লোহার তারের সাথে চুল বেধে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রাখা হতো, সেখানে চলতো সীমাহীন বর্বরতা।
বিরামহীন প্রহার আর অত্যাচারে মেয়েদের দেহের মাংস কেটে রক্ত ঝরছিল, কারো মুখের সামনের দিকে দাঁত ছিল না, ঠোটের দু'দিকের মাংস কামড়ে, টেনে ছিড়ে ফেলা হয়েছিল, লাঠি ও রডের আঘাতে হাতের আঙ্গুল, তালু ছিল থেতলানো। প্রসাব পায়খানার জন্যও তাদের হাত ও চুলের বাধন এক মুহূর্তের জন্য খুলে দেয়া হতো না। হেডকোয়াটারের বারান্দায় লোহার রডে ঝুলন্ত অবস্থায় তারা প্রসাব পায়খানা করতো।
অত্যাচারে কেউ মরে গেলে তখন অন্য মেয়েদের সামনে ছুরি দিয়ে দেহ কেটে কুচি কুচি করে বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হতো"

"অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তারা যখন একটু পানি চাইতো তখন হানাদার ও তাদের সহযোগীরা ডাবের খোসায় প্রসাব করে সেটা খেতে দিত"

"তাদের পরবার জন্য কোন শাড়ি দেয়া হতো না (যদি শাড়ি পেচিয়ে আত্মহত্যা করে তাই), দিনের বেলায় একটা তোয়ালে আর রাতে দেয়া হতো কম্বল! গোসলের প্রয়োজন হলে তিন জন করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়া হতো, রাজাকার ও পাকিরা দড়ির এক প্রান্ত ধরে রেখে তাদের নিয়ে যেতে গোসলে'..... (বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলীলপত্র, ৮ম খন্ড, হাসান হাফিজুর রহমান)


১৯৭১ পাকি বাহিনী তাদের দোস্ত রাজাকার ও দালালদের প্রতক্ষ্য সহযোগীতায় আট মাসে রক্ষনশীল হিসাবে বাংলাদেশে ৪ লক্ষেরও বেশি নারী ধর্ষন ও নির্যাতন করেছিল. বিশ্বের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। ছয় বছর ব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে 'গোটা ইউরোপে' নাৎসি ও ফ্যাস্টিট বাহিনী সম্মিলিতভাবে এত বেশি নারীকে ধর্ষন, নির্যাতন করেনি' (ড:এম এ হাসান, ২০০২, পৃ-৫)

যুদ্ধ যখন চলছিল তখন বেঁচে থাকাটাই ছিল মৌলিক বিষয়, সুতরাং এই বিষয়টা তখন সেই সময়ে মুখ্য হয়ে দেখা দেয়নি আর মানুষ বুঝতেও পারেনি এই ভয়াবহ জাতি ভিত্তিক ধর্ষনের বিষয়টা। কিন্তু যুদ্ধোত্তর কালে যখন একজন দু'জন করে ঘরে ফিরতে শুরু করলো তখন সৃষ্টি হলো এক এক সামাজিক ও মানসিক সংকটের। কারণ এই চার লক্ষ ধর্ষিতা নারী শুধু নয়, তাদের সাথে সম্পর্কিত চার লক্ষ পরিবার, সকল পরিবারই তাদের কে উদার চিত্তে গ্রহণ করেনি, অনেক নারী পরিত্যাজ্য হয়েছিলেন, অনেকে আত্নহত্যা করেছেন, রোগাক্রান্ত হয়ে ধুকে ধুকে মরে গেছেনে অনেকেই। সেই সাথে দেখা দিয়েছিল নারীদের দীর্ঘমেয়াদি শাররীক অসুস্থ্যতা, এই বিষয়ে ড: ডেভিস বলেছেন....

"৯ মাসে পাক বাহিনীদের দ্বারা ধর্ষিতা চার লাক্ষ মহিলার বেশির ভাগ মহিলাই সিফিলিস বা গনোরিয়া কিংবা উভয় রোগেরই শিকার হয়েছেন, এদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ভ্রুন হত্যাজনিত অভিগতা লাভ করেছেন। তিনি বলেন এরা বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারেন কিংবা জীবনভর বারবার রোগে ভুগতে পারেন।"

এর সাথেই যুক্ত হলো 'যুদ্ধ শিশু' বিষয়টার। নয় মাসের অত্যাচারে অনেকে ধর্ষিতা নারীই গর্ভবতী হয়ে পরেছিলেন, তবে তাদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। অসংখ্য গর্ভবতী মহিলা চলে গিয়েছিলেন ভারতে বা অন্য কোথাও গোপনে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। অনেক শিশু জন্মেছিল ঘরে দাইয়ের হাতে যার কোন রেকর্ড নেই। দুঃখজনক হচ্ছে যে, নির্ভরযোগ্য এবং ত্রুটিহীন কোন পরিসংখ্যানই নেই আমাদের হাতে, ফলে যুদ্ধ শিশুর সংখ্যা কত ছিল তার জন্য নির্ভর করতে হয় মুলত অনুমান এবং ধারণার উপর। সামান্য কিছু দলিলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সরকারী এবং বেসরকারী সংগঠনের আর কিছু কিছু আছে বিদেশী মিশন এবং মিশনারী সংস্থাগুলোর কাছে। সরকারী এক হিসাবে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা বলা হয়েছে তিন লাখ। ধর্ষণের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন গর্ভধারন করেছিলেন বলে জানা যায় (সুসান ব্রাউনমিলার, ১৯৭৫ : ৮৪)।
এই প্রসঙ্গে ড: ডেভিসের বলেছিলেন ..........

'আমরা বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে অবগত হবার আগেই অনিবার্য ও অবাঞ্চিত পরিস্থিতির চাপে আনুমানিক ১ লক্ষ ৭০ হাজার মহিলার গর্ভপাত করা হয়েছে গ্রামীন ধাত্রী বা হাতুরে ডাক্তারদের সাহায্য। সেবা কেন্দ্র গুলোতে ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল, তবে বেশির ভাগ নির্যাতিতারাই ক্লিনিকে আসতে পারেননি। (বাংলার বানী, ১৯৭২)।

সমসাময়িক পত্রিকা, বিচারপতি কে এম সোবহান, সিস্টার মার্গারেট মেরির ভাষ্য মতে ঢাকার বিভিন্ন ক্লিনিকে হাজার তিন শত গর্ভপাত করানো হয়েছে। আবার অনেকেরই গর্ভপাত সম্ভব হয়নি ফলে সেই সব শিশুরা জন্মগ্রহণ করে 'যুদ্ধ শিশু' হিসেবে। কানাডিয়ান ইউনিসেফের চেয়ারম্যান যুদ্ধ চলাকালিন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে দু'বার বাংলাদেশে আশার পরে তার রিপোর্টে ১০,০০০ যুদ্ধ শিশুর কথা উল্লেখ করেছেন। সুসান ব্রাউনমিলারের মতে সন্তান জন্ম দিয়েছিল এমন বীরাঙ্গনার সংখ্যা পঁচিশ হাজার।


কি হয়েছিল এই বাচ্চা গুলোর?

বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতায় সেই সময় এই শিশুরা সমাজে তৈরি করেছিল ভয়াবহ সংকট এবং সমস্যা। কেউ কেউ এই শিশুদেরকে বলে ‘অবাঞ্চিত সন্তান’, কেউ বলে ‘অবৈধ সন্তান’, কেউ বলে ‘শত্রু শিশু’ আবার কেউ বা নিদারুণ ঘৃণায় উচ্চারণ করে ‘জারজ সন্তান’ বলে।
অনেক নবজাতককে ইদুরের বিষ খাইয়ে, পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল এবং সর্বোপরি এই রাষ্ট্র তাদের এই দেশে থাকার অধিকার দেয়নি।
যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে সেই সময়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলেন ড: নীলিমা ইব্রাহীম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু বলেন....

"না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সম্মনের সঙ্গে মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না’। (ইব্রাহিম, ১৯৯৮ : ১৮)"

তখনকার প্রেক্ষপটে হয়তো সেই সিদ্ধান্তটাই সঠিক ছিল। কারণ এই সংকট ছিল একটা জাতীয় সংকট, আর সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয় বীরাঙ্গানা নারীদের পূর্নবাসন এবং যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে যা ভাবার, করবার তা শুধু বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সবাই ধীরে ধীরে এদের কথা ভুলে যেতে থাকে এবং আজ সেটা এক অনুচ্চারিত অধ্যায়।

যাক সে কথা, বঙ্গবন্ধু তখন জেনেভা ইন্ট্যারন্যাশনাল সোস্যাল সার্ভিসকে অনুরোধ করেন যুদ্ধ শিশুদের জন্য 'কিছু একটা করবার'।
বিদেশী নাগরিকরা যাতে সহজেই যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে পারেন সে জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রজ্ঞাপিত হয় The Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order। এরই ধারাবাহিকতায় আই এস এস, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিশনের সাহায্যে যুদ্ধ শিশুরা আশ্রয় পেতে থাকে বিদেশী বাবা-মায়েদের কাছে। সর্ব প্রথম যে দেশটি এগিয়ে এসেছিল আমাদের বাচ্চাদের আশ্রয় দিতে সেই দেশ কানাডা (মুনতাসির মামুন, ২০১৩, পৃ-৪৮,৪৯)
১৯৭২ সালে ১৯ জুলাই বাংলাদেশ থেকে ১৫ জন যুদ্ধ শিশু প্রথম কানাডার আশে- সেই সময়ে বিদেশী পত্রপত্রিকা গুলোতে এই বিষয়টা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল, তারা স্বাগত জানিয়েছিল এই উদ্যোগের। কলকাতার মাদার তেরেসা যুদ্ধ শিশুদের গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন এছাড়াও যে সব এগিয়ে এসেছিল যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে তার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন এবং অষ্ট্রেলিয়া।

কেমন ছিল এই যুদ্ধ শিশুরা ভিন দেশে, এই দুদ্ধ্যপোষ্য শিশুদের দিন কেমন করে কেটেছে, কি হয়েছিল তাদের ভাগ্যে?

বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়ায়ন ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষকতায় নিয়োজিত ডঃ বীনা ডি’কস্টা বিভিন্ন এডোপশন এজেন্সী, বাংলা ওয়েবসাইট এবং সংবাদপত্রে আবেদন জানিয়েছিলেন যুদ্ধ শিশুদের সাথে কথা বলার জন্য। খুব অল্প কয়েকজনই তাদের জীবন কাহিনী জনসম্মুখে প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিল। বীনা ডি’কস্টাকে লেখা ই-মেইলে এক যুদ্ধ শিশু লিখেছিলেন......

‘আমার দত্তক বাবা ছিল মহা বদমাশ এক লোক। সারাক্ষণই আমাকে অপমান করার চেষ্টা করতো সে, আমি বছর চারেক আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম! আমি সবসময়ই ভাবি যে আমি কেন এই ক্যানাডিয়ায়ান দম্পত্তির কাছে দত্তক হয়েছিলাম, যারা আমাকে দত্তক নেয়ার তিনমাসের মধ্যেই তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল।
আমার শৈশব ছিল বিভীষিকাময়। আমার যখন খুব প্রয়োজন ছিল তখন আমার নিজের দেশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার দিক থেকে। আর সে কারণেই আমি বাংলাদেশকে ঘৃণা করি। আমি মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে কাঁদি, কারণ আমার কোন শিকড় নেই। একারণেই আমি চেষ্টা করছি যেখানে আমি জন্মেছি সেই দেশ সম্পর্কে কিছুটা জানতে’।


আবার কেউ কেউ হয়তো বা নরওয়ে প্রবাসী কোহিনুরের অথবা জয়ের প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন তবে মোদ্দাকথা এই যে আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র, এই দেশের মানুষ কখনোই তাদের মনেও রাখেনি, স্বীকার করেনি।
কোহিনুরের মতো কোন যুদ্ধশিশু তার মায়ের খোজে আশে এদেশে কিংবা রায়ানের মতো নিজের দূর্দশা ক্ষোভের কথা জানিয়ে কেউ চিঠি লিখবে তখন আমরা একটু নড়েচড়ে বসবো, তারপর আবার একদিন সব ভুলে যাবো!
অথচ এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ তারাও, এই দেশের প্রতিটি মাটির কণায়, বাতাসে, এই পতাকায় তারও অধিকার ছিল, সেই অধিকার কি কেড়ে নেয়া হয়নি? কি অপরাধে?
এই অসহায় শিশুদের সম্পূর্ন ইতিহাস কোনদিন জানা যাবে না। তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি প্রাপ্ত মায়েদের মতো তারাও তারা হারিয়ে গেছে, কেউ মনে রাখেনি তাদের। বঙ্গবন্ধু এই মুক্তিযোদ্ধাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিলেও বৃহত্তর সমাজ এখনও মানসিক তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত না, এবং কিছু কিছু সময়ে শ্লেষাত্মক ভাবেও এই উপাধি ব্যবহার করা হচ্ছে.......এই বিষয়টা ভীষন লজ্জার, ভীষন কষ্টের।
বীরাঙ্গনা নামকরন সম্পর্কে সুলতানা কামাল বলেছিলেন.......
"স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সমস্ত নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল, যাদের ধর্ষন করা হয়েছিল, তাদের প্রতি সেই সময়ের যে নির্যাতন করা হয়েছিল, তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং তাদের রক্ষা করতে না পারা ছিল জাতির জন্য এক অসহায় লজ্জা। অত্যন্ত অবেগআপ্লুত মনোভাব থেকে তাদের নাম দেয়া হয় বীরাঙ্গনা'।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকরী অন্য নারীকর্মীদের ক্ষেত্রেও এই বিশেষণটি ব্যবহার করা হয় যেমন, আওয়ামী লীগের তদানীন্তন মহিলা সাংসদ বদরুন্নেসা আহমেদের মৃত্যুতে সংসদে যে শোক প্রস্তাব আনা হয়েছিল তাতে তাকেও বীরাঙ্গনা বলে অভিহিত করা হয়। " (মুনতাসরি মামুন, ২০১৩, ৪৪)

তবে আমরা আজ যা দেখছি, বাস্তবতা খুবই কঠিন। একটা সময় থেকে শুধু ধর্ষিতাদেরই বীরাঙ্গনা হিসাবে বোঝানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে অন্তর্জাল রবাবরই সোচ্চার ছিল, ইদানিং একটু বেশি। ভাল লাগে দেখতে তবে খুব কষ্ট পাই যখন দেখি গালি হিসেবে বলা হচ্ছে ' তুই পাকি বাবাদের রেখে যাওয়া বীর্য' কিংবা 'কয়জন পাকি মিলে তোরে বানাইছে' কিংবা 'চাঁদের বুড়ি এখন বীরাঙ্গনা' নামের কার্টুন, বিরোধী দলীয় নেতাকে "বীরাঙ্গনা" বলে উপহাস সুচক রসালো আলোচনা........ এসব দেখে মনে হয় আমাদের এই প্রজন্ম আমাদের অনেক আবেগ আছে ঠিকই কিন্তু আমরা কি আসলেই 'বীরাঙ্গনা' 'যুদ্ধ শিশু' বিষয় গুলোর সম্পর্কে ঠিক ভাবে জানি, ঠিক ভাবে হৃদয়ে ধারণ করি?
আমরা কি জানি এই দুই বিশেষণের পেছনে কত বেদনা, অশ্রু, ত্যাগ আছে?
একটু ভেবে দেখবেন কি??

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সামরিক পতিতালয়ে 'ধর্ষিত' কোরিয়ান ও ফিলিপিনো নারীরা দীর্ঘ ৫০ বছর পর তাঁদের কাছে জাপান সরকারের ক্ষমা ভিক্ষা করার দাবি জানিয়েছিল।

বাংলাদেশ কবে পাকিস্থানকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই লক্ষ লক্ষ নারী নির্যাতন, ধর্ষন, খুন করার জন্য ক্ষমা চাইতে বলবে??






সাহায্যকারী বই গুলো:

*স্বাধীনতার দলিল পত্র, হাসান হাফিজুর রহমান, ৮ম খন্ড, ১৯৮২।
*বীরাঙ্গনা ১৯৭১, মুনতাসির মামুন, ২০১৩।
*আমি বীরাঙ্গনা বলছি, ডা: নিলীমা ইব্রাহীম, ১৯৯৯।
*যুদ্ধ ও নারী, ডা এম এ হাসান, ২০০২।

এবং
নেট



এই সংক্রান্ত অবশ্যপাঠ্য তিনটি ব্লগ পোস্ট .....

* ফরিদ আহমেদের..আমাদের বীরাঙ্গনা নারী এবং যুদ্ধ শিশুরাঃ পাপমোচনের সময় এখনই
* ফারুক ওয়াসিফের..সেইসব বীরাঙ্গনা ও তাদের না-পাক শরীর

*অমি রহমান পিয়ালের বাংলাদেশের প্রথম যুদ্ধ শিশু জয়
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৪০
১০৬টি মন্তব্য ১০৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×