-এ্যই এ্যই এইদিকে একটু ফিরোতো। এটা একটুখানি খেয়ে দেখো। তোমার জন্য কি যে মজার আলুচপ বানিয়েছি! তুমি কত পছন্দ করোনা? সেদিন তো লিমাভাবীর বাসায় গিয়ে হাপুস হুপুস করে কি রাক্ষসের মতই না খেয়েছিলে। তাই তো শর্মী আপুর কাছ থেকে কাল মজাদার এক রেসিপি নিয়ে আজকেই বানিয়েছি। আরে খাওনা। এই দিকে ফিরোনা।ধ্যাৎ.........
এক হাতে গরম আলুচপের প্লেট আর আরেক হাতে শুকিয়ে যাওয়া আলুভর্তা মাখা হাত নিয়েই ওকে টানাটানি শুরু করে দেয় মৌ।
- আরে ! এত জ্বালাইস কেনো ? দেখতেছিস না অনেক ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করতেছি তো। বিরক্তি নিয়ে বলে রুমি।
-চোপ। রাখো তোমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ। ছুটির দিনে কাজ কি ?? চুপ থাকো। এইদিকে ফিরো । খাও আগে!!!!!!!!!!!!!!! নয়তো ....নয়তো এক বাড়ি দিয়ে তোমার কম্পু ভেঙ্গে ফেলবো খোদার কসম। রনরঙ্গিনী মূর্তী ধারন করে মৌ। কোমরে আঁচল জড়ানো মা চন্ডালিনী রুপে চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৌ এর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে রুমি।
-আচ্ছা দে। কি রাজভোগ বানাইসিস দেখি। দুইহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ হা করে রুমি।
মৌ মহা খুশী হয়ে আহ্লাদে গদ গদ হয়ে এক টুকরো আলুচপ ভেঙ্গে মুখে তুলে দেয় ওর। কিন্তু এক কামড় দিয়েই তিড়িং করে লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে রুমি। উহু আহ এহ যত রকম কষ্টের শব্দ আছে তাই বেরুতে থাকে ওর মুখ দিয়ে। দৌড়ে বেসিনে যায়। ট্যাপ ছেড়ে কুলি করে। পানি পানি করে চিল্লাতেও শুরু করে।
ততক্ষনে আলুচপের প্লেট ফেলে দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে এসেছে মৌ। রুমি পানি খেয়ে একটু শান্ত হয়েই আবার চিৎকার দিয়ে ওঠে,
- কি বানাইসিস এই সব? ঝালে ভর্তি। পারিস না, কিছুনা আবার ঢঙ দেখায় এইসব ছাই ভস্ম বানাইতে যাস, না? ? আলু ভর্তা করে একগাঁদা কাঁচামরিচ দিয়ে ভাজলেই আলু চপ হয়ে যায়? গাধী, আলু ভর্তা করে আর ভাজে। তাই আবার খাওয়াইতে আসছে সাধ করে। দুমদাম পা ফেলে চলে যায় রুমি ওর অফিস রুমের দিকেই।
ততক্ষণে মৌ এর মুখ আষাড়ের আকাশ। মৌ জানে রুমি একেবারেই ঝাল খেতে পারেনা। কিন্তু শর্মী আপুর রেসিপি ফলো করতে গিয়েই এই ভুলটা করেছে সে। চোখ ফেটে কান্না আসে ওর। বাচ্চা মেয়েদের মত যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে দাঁড়িয়েই থাকে। চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তে শুরু করে।
কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে আসে রুমি। মৌকে এ অবস্থায় দেখে বুঝতে পারে কত বড় ভুল করে ফেলেছে সে। আহা বেচারী কত শখ করে একটা খাবার ওকে বানিয়ে খাওয়াতে গেছিলো। এমন আচরন করাটা তার খুবই ভুল হয়ে গেছে।
কাছে এসে মৌ এর একটা হাত ধরে রুমি।
- এ্যই পাগলী! কাঁদিস কেনো?
রুমির এই কথায় মৌ এর কান্নাটা আরও শতগুন বেড়ে যায়।রিতীমত ফোঁপাতে শুরু করে সে। ভীষন খারাপ লাগে রুমির। কেনো যে মাঝে মাঝে সে এমন আউট অফ কট্রোল হয়ে যায়! নিজের উপর রাগ লাগে ওর। মৌকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় রুমি। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় মৌ এর কান্না ভেজা মুখটা। শক্ত হয়ে ওর বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে মৌ। রুমির শার্টের বুকের কাছটা একদম ভিজে চুপচুপ তখন মৌ এর কান্না জলে।
কালো কুঁচকুঁচে রাতের আকাশে কোথাও চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তবে আকাশ ভরা একঝাঁক ঝিকিমিকি তারা। মনে হচ্ছে যেন আকাশে বসেছে আজ তারার মেলা। ছাদে মাদুর বিছিয়ে পাশাপাশী শুয়ে সেই তারার মেলায় সামিল হয়েছে মৌ আর রুমি। অবশ্য অন্য সময় হলে রুমি হয়তো বলতো
-হইসে তোর খেয়ে কোনো কাম না থাকলে তুই না হয় বসে বসে আকাশের তারা গুনতে পারিস বাট আমি কেনো? আমার তো খেয়ে দেয়ে মেলা কাম আছে।
কিন্তু আজ মৌকে সে হঠাৎ নিজেরই অজান্তে খুব বেশী দুঃখ দিয়ে ফেলেছে। তাই শত কাজ ফেলেও মৌ এর এই বিশেষ প্রিয় কাজ আকাশের তারা গুনতেই সে বসেছে মৌ এর সাথে। বিশেষ করে পূর্নিমা রাতে ছাঁদে শুয়ে শুয়ে তারা দেখতে মৌ এর নাকি দারুন এক এক্সাইটমেন্ট লাগে। উফ মানুষ যে কত রকমের পাগল হয়!
মাঝে মাঝে অবাক লাগে রুমির। ওর মত ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে একটা ছেলেকে কি মায়াজালে বাঁধলো এই মেয়েটা! নিজেকে ছাড়াও মৌকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে রুমি আচ্ছা আমি কেনো তোর সব কথা শুনি? কেনো তোকে খুশী করতে জান দিয়ে দেই?
সে কথা শুনে হাসতে থাকে মৌ। মাঝে মাঝে ভেংচি কেটে বলে ,
- এহ !! সব কথা শুনো, না!!! শয়তানের লাঠি। তোমার মত এমন শয়তানের লাঠি কি ইহজগতে আর দুইটা আছে!!!
বেশ কিছুক্ষন যাবৎ মৌ এর কোনো সাড়া শব্দ, গুনগুনানি নেই দেখে ওকে একটু ধাক্কা দেয় রুমি। আরে মহারানী দেখি ঘুমায় গেছে! আস্তে করে ডাক দেয়।
-মৌ? নীচে চল । ঘুম পাইসে তোর। কোনো সাড়া শব্দ নেই। আবারও একটু ধাক্কা দিয়ে ওকে জাগাতে চেষ্টা করে রুমি।
মৌ এবার আরও আয়েস করে পাশ ফিরে ওকে আরও বেশী আকড়ে ধরে অধিকতর নিশ্চিন্তেই ঘুমিয়ে যায়।
-মৌ ওঠনা । ঘুমায় গেছিস তো। নীচে চল। সে কথা শুনে আহ্লাদী বেড়ালের মত দুহাতে রুমির গলা জড়িয়ে ধরে অস্ফুটে বিড় বিড় করে মৌ।
- আমি এখন উঠতে পারবোনা।
- উঠতে পারবিনা মানে? তাইলে কি আমি এখন এই দশমনি আটার বস্তা কোলে তুলে নিতে গিয়ে কোমর ভাঙ্গবো নাকি!!!!!
-কি???????? চোখ পাকিয়ে উঠে বসে মৌ। আমি আটার বস্তা! আমি দশমনি!! তাইলে কে তোমার স্লিম ফিগার ঐশ্যারিয়া শুনি!! কে তোমার জিরো ফ্যাট বেড়ালমুখী কারিনা? কে তোমার ... কে তোমার ....??? দুমদাম কিল মারতে থাকে মৌ রুমির বুকে। হো হো করে হাসতে থাকে রুমি। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে ওর।
- যাক বাবা বাঁচলাম। এটলিস্ট দশমন ওজন তুলে কোমর ভাঙ্গার চান্স থেকে তো বাঁচা গেলো।
রাত দুইটা দশ! যথারিতী পিসি এর সামনে রুমি। কালকের মধ্যে কাজটা শেষ করতেই হবে। হঠাৎ পাশে রাখা সেলটা ভাইব্রেট করতে শুরু করে। এতটুকু শব্দেও যেন মৌ এর ঘুম না ভাঙ্গে তাই রিংটোন অফ রাখা। স্ক্রিনে তাকায় রুমি। এত রাতে কার ফোন? যা ভেবেছিলো তাই। রেহান গাধাটা ফোন দিয়েছে। নাহ আসলেই দেখি গ্যাড়াকলে আছে বেটা।
-কিরে কি খবর?
- কি আবার? এই তো ভালোই। জেগে আছিস তাইলে?
- আমি নিশাচর এইটা কি নতুন?
- হা হা হা তা না । নাহ মৌ তোকে বদলাইতে পারলোনা আর দেখতেসি।
- হ্যাঁ আর আমার বোন কি পারছে? তোকে বদলাইতে? হা হা হা হা হাসতে শুরু করে রেহান।
- হুম বড় ফূর্তীতে আছো। প্রেমে পড়লে এমনি হয়। কারনে অকারনে ফূর্তী লাগে।
- তো বল এখন ? তোর বেতুল সাকারিয়ার কি অবস্থা? সেদিন তো কল কেটে যাবার পর আর কলই দিলিনা কিপটা।
- ওহ হ্যাঁ। কি আবার ? সামারী তো বলছিই ভুলতে পারতেছিনা আমি মেয়েটাকে।
-ঘটনাটা একটু খুলে বলতো দোস্ত।
- প্রথমটুকু তো বলছিই। এখন বলি সেকেন্ড পার্ট। আমাদের টু আওয়ার্স লান্চ ব্রেক ছিলো। সে আমাকে বললো একটা জোস জায়গা দেখাবে। সো অন দ্যা ওয়ে সে বললো তার কথা ও তার ফ্যামিলির কথা।
-Is she married ??
-No and she is only 24.
- এখন বল আসল ঘটনা।
- আসল ঘটনা হইলো এই মেয়েকে আমি ভুলতে পারতেছিনা। কিছু চিন্তাও করতে পারতেছিনা। আমি পালায় আসছি। ফ্লাইট চেন্জ করে ওকে কিছু না বলেই চলে আসছি আমি।
- এইটা করার রিজন কি?
-আমার মনে হচ্ছিলো আমি ঝামেলায় জড়ায় যাচ্ছি। সো বেঁচে গেছি।
-Are you sure যে তুই বেঁচে গেছিস ???
- জানিনা।
- You should call her. & say ,
-I am missing u. can,t live without u . হেলো হেলো । উপস আবার লাইনটা কেটে গেলো। রুমি চেয়ার ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়াতেই, পেছনে দাঁড়িয়ে মৌ।
-কাকে মিস করছিলে?
- আমার গার্লফ্রেন্ডকে। হাসি হাসি মুখে রসিকতা করতে চাইলো রুমি।
- ফোনটা দাও। কার সাথে এত রাতে ফিসফিস করে কথা বলছিলে আমি জানতে চাই। মৌ রুমি এর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করে।
রুমি মৌ এর কাছে কিছুই লুকায়না বাট সে চাচ্ছিলোনা রেহানের এই ব্যাপারটা নিয়ে মৌকে কিছু জানাতে। রেহান শুধু তার বন্ধুই না আরো অনেক কিছু এবং তার বোনের হাসব্যান্ডও। কাজেই রুমি কোনোমতেই ফোনটা মৌকে দিতে চাইলোনা।
হঠাৎ অপরিসীম ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়লো মৌ রুমি এর উপর। আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিতে চায় বুঝি আজ সে ওকে।
- হারামী তোর স্বভাব আজও বদলায় না?????? তোকে যে আমি এই জানটা দিয়ে ভালোবাসি সে সবের কোনো মূল্য নেই না??? সুযোগ পেলেই তুই এদিক ওদিক .... .....
এমনিতেই একদিকে বোন, বোনের হাসব্যান্ড, তার উপর তার বেস্ট ফ্রেন্ড এর এসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া তার উপর মৌ এর এমন সব আজগুবী কটাক্ষ বুঝি আর সহ্য হয়না রুমির। হঠাৎ প্রচন্ড এক চড় কষিয়ে দেয় ও মৌ এর গালে।
মৌ অবাক হয়ে যায়! এত অবাক বুঝি সে এই জীবনে আর কখনও হয়নি! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রুমির দিকে। তারপর টু শব্দটি না করে ফিরে যায় নিজের রুমে।
ভোর প্রায় ৫টা। অফিস রুমেই রকিং চেয়ারটায় চোখ বুজে শুয়ে আছে রুমি। খুব খারাপ লাগছে ওর। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না কিছুতেই। তবে এই যে এত ভালোবাসা তার এই মেয়েটিকে ঘিরে সে কথাটাই বা কেনো বুঝবেনা মৌ ? কেনো কারণে অকারণে সন্দেহ করবে তাকে? না হয় একটু বেশী ফান করে ফেলে রুমি? তাই বলে কি সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝবেনা মৌ? সে কি জানেনা ওর মুখের একটু হাসির জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা সে করতে পারেনা। প্রচন্ড অভিমান হয় ওর। নিজের উপরও রাগ লাগছে ভীষন। কেনো যে আজও নিজেকে কন্ট্রোল করা শিখলো না সে।
এত ভোরে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের হবার শব্দে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করে রুমি। মৌ এর গাড়িটা বের হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে বারান্দায় যায়।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মৌ। মাই গড ! কোথায় যাচ্ছে মৌ এত ভোরে?
দৌড়ে আসে রুমি মৌ এর রুমে। পরিপাটি ঝকঝকে তকতকে শুন্য ঘর, এলোমেলো বিছানা। কোথাও কেউ নেই।
চলবে.......
১ম পর্ব
২য় পর্ব
তৃয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১০:২৭