somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যতিক্রমী ঈদ…

১৩ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১০:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজও মুনিরার মামা মুনিরার জন্য আরেকটা খুব সুন্দর একটা সেলোয়ার কামিজ কিনে এনেছে। কয়েকদিন আগে তার দুই খালামনি এসে তাকে ড্রেস সেট আর তার সাথে ম্যাচ করে অর্নামেন্ট এর সেট দিয়ে গেছে।কয়েক দিন পর পরই এক এক জন বাসায় আসছে আর মুনিরার সামনে গিয়ে বলছে ‘মা তোমার জন্য এটা এনেছি,ধর রাখো…’ আর মুনীরাও মলিন হাসি হেসে সেই গিফটগুলা হাতে নিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে রুমে চলে যায়।এবারের ঈদ এই মেয়েটা যেন অনেক হাসি খুশি ভাবে করতে পারে সেই ব্যর্থ চেষ্টায় মগ্ন সবাই।কত রকমের কত কিছুই না করছে।আজ এইটা কাল ঐটা… অথচ মুনীরা…!! এত কিছু পাওয়ার পরও যেন কোন কিছুই তাকে আগের মত করে হাসাতে পারে না আর।কিংবা আগের মত আর উচ্ছলতায় ভরিয়ে তুলতে পারেনা।


যেই মেয়ে সামান্য কথায় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়তো।অকারনেই অনর্গল কথা বলতেই থাকতো।আর খুব সহজেই সবাইকেই আপন করে ফেলতে পারতো আজ সেই মেয়েটার সাথে যেন আগেই মূনিরার কোন মিল নেই।বংশের এক মাত্র মেয়ে হওয়ায় এই মেয়েটাই যেন ছিল সবার মধ্যমনি।মামারা, খালামনিরা,চাচ্চু ফুপ্পিদের সবারই কলিজার টুকরা হচ্ছে এই মুনিরা।তাইতো কোন আবদারের কথা বলা মাত্রই সবাই পাগল হয়ে যেত পূরন করতে।আর এই মেয়েটাই কিনা আজ একদম চুপ হয়ে গেছে।তার কথায় কথায় লুটিয়ে পড়া সেই মিষ্টি হাসিটা যেন দিনের পর দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে।কিছু কিছু ঘটনা আসলেই খুব বেশি পরিবর্তন করে দেয় মানুষের সাজানো জীবনটাকে।সকল হাসি আনন্দ কেড়ে নিয়ে কষ্টের সাগরে ঠেলে দেয়।মুনিরাও যেন এর ব্যতীক্রম নয়।


গত বছর প্রথম রোজা থেকেই মুনিরা ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান শুরু করেছিলো সবার সাথে একসাথে ঈদের শপিং করবে বলে।কিন্তু ব্যস্ততার জন্য সেই সময় কারই হয়ে উঠছিলোনা।তার শুধু ঘুরে ফিরে একটাই কথা এবার একা একা কিছুই শপিং করবেনা সবাই মিলে শপিং এ যাবে আর খুব মজা করে কেনাকাটা করবে।কিন্তু সবার ব্যস্ততার কারনে কারও সময় হয় তো আবার কারও হয়না এমন করতে করতে প্রায় ১০টার মত রোজা শেষ হয়ে যায়।


এরপর সে শুরু করে মা বাবার সাথে চরম ফাইট।সবাই একসাথে শপিং এ যাবে আর না গেলে সে এবার ঈদই করবেনা।অনেক করে বুঝানোর পরও অবুঝের মত সেই একই কথা তোতা পাখির মত আওড়াতে থাকে।কোন ভাবেই তাকে বুঝানো যাচ্ছিলো না।এরপর ফোনে তার ফুপ্পু তাকে এই বলে থামায় যে সবাই ঈদের ছুটি টা পাক এরপর না হয় একসাথেই যাওয়া যাবে এখন যেন সে তার মা বাবার সাথে গিয়ে শপিংটা করে ফেলে।কিন্তু নাছোরবান্দা মুনিরা মায়ের কাছে গিয়ে গম্ভীর হয়ে বলে-‘শোন আম্মু আমি সবার সাথেই যাবো আর তোমার ইচ্ছে হলে তুমি বাবাকে নিয়ে শপিং শেষ করতে পারো…’


মুনিরা কেমন তা তার মা খুব ভালো করেই জানেন উনি তাই আর কথা না বাড়িয়ে পরদিন ইফতারের পর মুনিরার বাবার সাথে একসাথে উনারা দুজন বের হন।যাওয়ার আগে মুনিরা দৌড়ে গিয়ে মা যেন না দেখতে পারে তাই লুকিয়ে লুকিয়ে ছোট্ট একটা লিস্ট ধরিয়ে দেয় বাবার হাতে।আর বাবাও মুচকী হেসে ঐ লিস্টটা নিয়ে সাথে সাথে পকেটে ঢুকিয়ে মুনিরাকে ছোট্ট করে আদর করে দিয়ে শপিং এর উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান।


লিস্টটাতে মুনিরা যা যা লিখেছিলো তার কোনটাই বাদ পড়তে দেননি মুনিরার বাবা।সবই কেনা হয়েছে তার উপর আবার মেয়ের জন্য সুন্দর সাদার মাঝে সাদা কাজ করা একটা লেহেঙ্গাও কিনে ফেলেন মেয়েকে সারপ্রাইজ দিবে বলে।লেহেঙ্গাটা কেনার পর তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠে মেয়েটা ঐ ড্রেস পড়ে খুশিতে লাফাচ্ছে।এই ড্রেসে মেয়েটাকে একদম পরীর মত দেখাবে...অদ্ভুত সুন্দর লাগবে পরীকে... ভাবতে ভাবতে চোখের কোনে পানি জমে যায় তাঁর।মুনিরার আম্মু যাতে বুঝতে না পারে তাই চোখের পানি আড়াল করে ফেলেন খুব দ্রুতই। প্রতি বছরের মতন এই বারও মেয়ে কে ঈদের আগের রাতে সারপ্রাইজ দিবে।কারন এই সারপ্রাইজটা দেয়ার পর মেয়ে যখন লাফ দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে আদর করতে থাকে শুধুমাত্র এই মিষ্টি ক্ষনটার জন্য সবসময় ব্যাকুল থাকেন উনি…কিন্তু সবসময় অনেক কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও ব্যস্ততার জন্য আর করা হয়ে উঠেনা।

-এই সি এন জি যাবে……?? মুনিরার আম্মুর হাকডাকে বাস্তবে ফিরে আসেন।সি এন জিতে উঠেই মুনিরার আম্মু কে আদেশের সুরে বলেন,

-শুনো আমি যে পরীর জন্য এই লেহেঙ্গাটা কিনেছি ওকে কিন্তু বলবানা।ঈদের আগের দিন রাতে আমি বের করে দিবো।সেই ভুবন ভোলানো হাসি না দেখে কিভাবে ঈদ করি বল?

-তোমরা মেয়ে আর বাবা আর কি করবা বলতো?তুমি আবার মুনিরাকে কিছু বলবানা।সেও তোমার জন্য কি যেন একটা কিনে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলছিলো।তোমরা পারও…হাসতে থাকেন উনি।

এই কথাটা শুনে মুনীরার বাবা চোখ মুছতে মুছতে বলেন-আল্লাহ আমাদের কে একটাই সন্তান দিয়েছেন।আর জানোই তো কত কষ্টের পর আমরা পরীটাকে বুকের মাঝে পেয়েছি।এই মেয়েটার জন্য কত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।বলতে বলতে গলা ধরে আসে মুনিরার বাবার।আর তা বুঝতে পেরেই মুনিরার আম্মু ঝটপট করে অন্য কথা বলে গাঢ় পরিবেশটাকে হালকা করে দেয়।


রাত প্রায় ১টা বেজে গেছে।অথচ তাঁদের দুজনের বাসায় আসার কোন খবরই নেই।সবাই একে ওকে ফোন করছে পাগলের মত।আর মুনিরাও শুধু ‘আম্মু’ ‘বাবা’ বলে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে গেছে।রাত প্রায় ২টার সময় অচেনা নাম্বার থেকে ফোন।মুনিরার বড় মামা খুব নর্মাল ভাবেই ফোনে কথা শেষ করে মুনিরাকে নিয়ে হসপিটালের দিকে রওয়ানা দেয়।অজানা আতঙ্কে মুনিরা থর থর করে কাঁপতে থাকে।আর মামার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে।কিন্তু হসপিটালে পৌছানোর পরই ডাক্তার তাদের সামনে রক্তের প্রলেপ মাখা কাপড়ে মুড়ানো দুটো মানুষকে স্ট্রেচারে করে যখন নিয়ে আসে সাথে সাথে মুনিরার মামা তাকে কোলে তুলে চিতকার করে কান্না শুরু করে দেয়।আর মুনিরাও বুঝে ফেলে যে তার পরম আদরের ভালবাসার জায়গাটা আজ এখানেই ইতি টেনেছে।আর ফিরে পাওয়া হবেনা প্রিয় এই মানুষ দুজন কে।মুহুর্তেই ১২ বছরের সেই ছোট্ট মুনিরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।একটি এক্সিডেন্ট সব কিছু কেড়ে নিয়ে যায়।হাসি আনন্দে ভরা এ জীবন এক নিমিষেই অন্ধকারে ছেয়ে যায়।কিছু মানুষকে খুব বেশি একা করে দেয়…!!!


গত বছরের কিছু অনাকাঙ্খিত মুহুর্তগুলো যেন বার বার মুনিরার ভাবনার জগতে এসে কড়া নাড়ে।মা বাবাকে নিয়ে যতবারই সে মজার মজার দিনগুলোর কথা ভাবতে চায় ততোবারই যেন সেই ভয়ঙ্কর দিনগূলো তার সামনে ভাবনায় এসে হানা দেয়।আর যেন ভাবতে পারেনা মুনীরা।প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায় তার।জানালার পর্দা সরিয়ে সে রাতের ঐ বিশাল কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।আর অনর্গল টূপ টূপ করে চোখের পানি ঝর্নার মত ঝরতে থাকে।


হঠার করেই মুনিরার মনে হয় মা বাবা যেন একসাথে দাঁড়িয়ে ‘মা আয়না মা…বুকে আয়…’ বলে হেসে হেসে তাকে ডাকছে।ব্যাকুল হয়ে যায় সে ছুটে যাওয়ার জন্য।চিতকার করে বলতে থাকে -বাবা আমি তোমাদের কাছে যাবো… বাবা আমাকে নিয়ে যাও না তোমাদের ওখানে।আমি আর তোমাদের ছাড়া আর থাকতে পারছিনা…আম্মু আমি আর তোমাকে জ্বালাবোনা…আমি যাবো তোমাদের কাছে……!!!


রুমের লাইট অন করে মামা রূমে ঢুকে দেখে মুনিরা জ্বরে কাপছে আর ঘুমের ঘোরে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে।কাছে গিয়ে কোলে তুলে নেয়।কপালে গালে চুপু দিয়ে বলতে থাকে - মা চুপ থাক কথা বলিস না …এই যে আমি আছি তোর পাশে…একটু ঘুমা…একটু চুপ থাক…!!!!


ঘুমের রাজ্যে চলে যায় মুনিরা।কি জানি এরপর সেই রাজ্য থেকে মুনিরা আবার ফিরে এসেছিলো কিনা নাকি ঐ ঘুমের মধ্য দিয়ে সে বাবা মার হাত ধরে আকাশের মাঝে মিলে গিয়েছিলো ।হয়তো সে বাবার কিনে দেয়া সাদা ধবধবা সুন্দর লেহেঙ্গাটা পড়ে বাবার কোলে বসে পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে সেই চেনা ঘ্রান নিচ্ছে।আর একটু পর পর দু জনেরই চুমু খাচ্ছে…হয়তো মা বাবার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলছে 'আর হারাতে দেবো না তোমাদের...' হয়তো আরও অনেক কিছু… !!!!


***দুর্ঘটনা গুলো কখনই বলে কয়ে আসে না।কিন্তু কিছু দুর্ঘটনা হঠাত করে আসলেও সেটা মেনে নেয়াটা খুব বেশি কষ্ট হয়ে যায়।হয়তো সহ্য করাটাও অনেক বেশি দুঃসাধ্য মনে হয়।কারও জীবনে এমন দুর্ঘটনা না আসুক আর কেও এমন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির শিকার না হোক এই কামনাই রইলো…….***

সবাইকে ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা…
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:২৮
৪৬টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×