বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে 'বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত' করা হবে_ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এমনই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি আর অনিয়মে সরকারের গত চার বছরে উল্টো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব বিমানের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নিষ্প্রভ করে তোলে। বন্ধ হয়ে যায় লাভজনক বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক রুট। ফ্লাইট শিডিউল লণ্ডভণ্ড হওয়ায় যাত্রীদের বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে অসংখ্যবার। দুবাইয়ে ফ্লাইটে ওঠার আগমুহূর্তে ঢাকাগামী ৩০০ যাত্রীকে ফেলে রেখেই বিমানের ভাড়া করা উড়োজাহাজ আকস্মিক অজানার উদ্দেশে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনা শুধু দেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বেও প্রথম। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, চাকরি হারানোর আতঙ্ক ছিল সরকারের শুরুর বছর থেকেই। অভিজ্ঞ অনেক কর্মকর্তাকে কোনো কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়। দীর্ঘ চার বছরে দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী এই এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠান।
বিমানমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছেন, কয়েক বছরের মধ্যেই বিমানের বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হবে। নতুন উড়োজাহাজগুলো যুক্ত হলে দু-তিন বছরে বিমান লাভের মুখ দেখতে শুরু করবে বলে মন্ত্রী জানান।
বিমান সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের চার বছরেই বিমান লোকসান ছাড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটির দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এখন প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সূত্রমতে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনা ও লাভজনক করতে কোম্পানিতে রূপান্তরের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের চার বছরে বাস্তবায়নের ধারেকাছেও পেঁৗছাতে পারেনি ওই রোডম্যাপ। বরং পুরনো ধারায় ফিরে যায় বিমানের ব্যবস্থাপনা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাহীন যাত্রায় আকাশে ডানা মেলার ক্ষমতাই এখন হারাতে বসেছে বিমান। দুর্নীতির তদন্ত ও বাণিজ্যিক পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করে বিমান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, আন্তর্জাতিক এভিয়েশন ব্যবসা সম্পর্কে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের কোনো ধারণা নেই। সঠিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে না পারায় সংস্থাটি ব্যবসা ক্ষেত্রে সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না বলেও মনে করেন কমিটির সদস্যরা। জাতীয় এ সংস্থাটির সংকট কাটাতে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের জন্য একাধিকবার তাগিদ দিয়েছে কমিটি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি সিলেটে বিমানের এক অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশ বিমান একটি অযোগ্য ও অদক্ষ প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালনায় দক্ষতা না আনলে এবং ব্যবস্থাপনায় উন্নতি না ঘটালে এ থেকে সরকারের সব সমর্থন উঠিয়ে নেওয়া হবে।
অবশ্য বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক কিছু ক্ষেত্রে বিমানের অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, এ সময় ফ্লাইটসূচি আগের চেয়ে বেশি নিয়মিত হয়েছে। যাত্রীসেবার মান বেড়েছে। বহরে ভাড়ায় চারটি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া বন্ধ আন্তর্জাতিক গন্তব্যগুলোর মধ্যে ব্যাংকক ও দিলি্ল ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা সত্ত্বেও চার বছরে নিউইয়র্ক ফ্লাইট পুনরায় চালু করতে পারেনি বিমান। কবে নাগাদ চালু করা যাবে, তাও অনিশ্চিত।
সংসদীয় কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, 'বিমান নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা থেতিয়ে গেছি। এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। কমিটির কোনো সুপারিশ মন্ত্রণালয় মানে না।' তিনি বলেন, চার বছর ধরে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানকে ঘিরেই হচ্ছে দুর্নীতি আর লুটপাট। তার একরোখা সিদ্ধান্তের কারণে বিমান আজ দুর্নীতির শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে। অনেক আগেই পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা উচিত ছিল বলে মনে করেন কমিটির ওই সদস্য। বিমানের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে চলছে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের শীর্ষ মহলে তার শক্ত যোগাযোগ বলেই নিজের ইচ্ছা মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনের একযোগে অবস্থান নিয়েও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো মন্ত্রীকেই মন্ত্রণালয় থেকে সরে যেতে হয়েছে।
ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব : মহাজোট সরকার গঠনের পর মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও কর্তৃপক্ষের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বিমানের ত্রিশঙ্কু অবস্থার সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদেরের সঙ্গে পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ এবং হায়ার অ্যান্ড ফায়ারের ক্ষমতা নিয়ে পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামালউদ্দিনের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ নিয়ে মন্ত্রী আর চেয়ারম্যানের মুখ-দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। দুজনই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরস্পরের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। বিমান নিয়ে মন্ত্রী তেমন কিছু আর করতে পারেননি। বিমানবন্দরের প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৪০০ বিঘা জমির লিজ বাতিল নিয়েও সংসদীয় কমিটি সাবেক বিমানমন্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। কমিটির সদস্যরাও মন্ত্রীর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পরে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় পর্ষদের সঙ্গে। বৈদেশিক অফিসের দুর্নীতি নিয়ে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে চেয়ারম্যানের এ দ্বন্দ্ব বহুদূর এগোয়। সেই দ্বন্দ্ব এখনো প্রকট। মন্ত্রী বদল হলেও সেই দ্বন্দ্বটি আর বন্ধ হয়নি।
শুধুই লোকসান : বিমানের হিসাব নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে পর পর দুই অর্থবছরে (২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯) প্রতিষ্ঠানটি যথাক্রমে ১৯ কোটি ৯৪ লাখ ও ৬৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা লাভ করে। কিন্তু বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমান লোকসান দিতে শুরু করে। ২০০৯-১০ অর্থবছর ৮০ কোটি ১৩ লাখ ৬২ হাজার, ২০১০-১১ অর্থবছর ১৯৯ কোটি টাকা এবং চলতি ২০১১-১২ অর্থবছর ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়ে গেছে। বর্তমান অর্থবছরে লোকসান ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
দেনায় জর্জরিত : বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, এয়ারলাইনস ও ট্রাভেল এজেন্টের কাছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাওনা ২৩২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। অথচ রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটির দেনার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি পদ্মা, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিমান গত চার বছরে এই বিপুল অঙ্কের টাকার দেনায় পড়েছে।
২৬ থেকে ১৬ রুট : অব্যাহত লোকসান, ফ্লাইট সংকট, রুট কমানো, অদক্ষ জনবল, যাত্রীদের মালামাল চুরি, ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ বিমান। কোম্পানি হওয়ার পর সংস্থাটি লোকসান দিয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ফ্লাইট সংকটের কারণে বিমানের রুট সংখ্যা ২৬ থেকে ১৬-তে নেমে এসেছে।
ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে বিমান : দীর্ঘ আট মাসেরও বেশি সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চলছে বিমানের এমডির পদ। এয়ারলাইনসের স্থায়ী এমডি হিসেবে সর্বশেষ নিযুক্ত ছিলেন জাকীউল ইসলাম। গত বছর ২০ এপ্রিল তিনি নিজ পদ থেকে ইস্তফা দেন। এর দুই দিন পরই বিমান এই পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দেয় সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) ক্যাপ্টেন শেখ নাসির উদ্দিন আহমেদকে। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন বিমানেরই পরিচালক (ক্রয় ও সংরক্ষণ) মোসাদ্দেক আহমেদ।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




