আজকের পর্বটি অন্য পর্বের চেয়ে কিছুটা আলাদা। পুরোপুরি অতীতের গল্প নয়, তার সাথে ভবিষ্যৎকেও কিছুটা নিয়ে এসেছি। গল্প আকারে নয় অনেকটা এলোমেলো একটা ডায়েরীর পাতা ধরে নিতে পারেন এটাকে।
পূর্বের পর্ব:
মেয়েটি চলল প্রবাসের পথে - আগমনী বার্তা (সামু পাগলার নতুন সিরিজ )
মেয়েটি চলল প্রবাসের পথে - বিদেশ গমনে শ্বশুড়বাড়ির পারমিশন! (পূর্বের পর্বের বিজয়ী ঘোষিত)
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
১) কৌতুহলী পাবলিক!
আমার কাজিনদের বেশিরভাগই ঢাকার নামী দামী ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ত, কিন্তু আমি মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামে পড়তাম। সেজন্যে কাজিনদের কাছে খুব একটা পাত্তা পেতাম না। তবুও নিজের কোন ভাই বোন না থাকায় ওদের পিছে পিছে ঘুরতাম কেননা নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ওরাও আমাকে সারাদিন পচাত, ক্ষেপাত কিন্তু দিনশেষে খেয়ালও রাখত।
তবে বিদেশে যাবার কথা ছড়িয়ে যেতেই অনেককিছু পাল্টে গেল। কিছু কাজিন ভয় দেখাচ্ছিল বিদেশের ব্যাপারে নানা কথা বলে কিন্তু বেশিরভাগই হুট করে দাম দিতে শুরু করল। আমার দিকে কেমন হিংসা হিংসা চোখে তাকাত আর হাজারটা প্রশ্ন করত। যেমন:
বিদেশে গেলে কি সাদা হয়ে যাবি? জিন্স টপ পড়বি? ইংলিশে কথা বলবি? ওখানে তো বরফ পড়ে আকাশ থেকে, সেটা গলে পুকুর হয়ে যায়না? স্কুলে কি স্কিয়িং করতে করতে যাবি? ওখানে রাস্তা নাকি এত পরিষ্কার যে চেহারা দেখা যায়? সবাই বড়লোক হয়, ফকির থাকেনা, তাইনা? ওখানে কাজের লোকও ইংলিশে কথা বলে?
আমি সবসময় নিজের কাজিনদেরকে ড্যাম স্মার্ট ভাবতাম কিন্তু এতসব প্রশ্নে মনে মনে ভাবতে বাধ্য হলাম - গাধারা আমি বিদেশ ফেরত নই, বিদেশে যাচ্ছি - এতকিছু জানব কি করে?
যদিও মুখে সেটা না বলে আমি বিজ্ঞের মতো গম্ভীর ভাবে হ্যাঁ হু করতে থাকলাম। ওদের যদি বলে দেই কানাডা সম্পর্কে আমার তেমন কোন আইডিয়া নেই, তাহলে নব্য পাওয়া প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যেত।
বিদেশে যাবার ব্যাপারটিতে আমি প্রথম খুশি হতে থাকি কাজিনদের কারণেই। মনে হয়, এটা কি এত এত ভালো একটা ব্যাপার যে আমার মতো বোকামতী কে সেলিব্রেটি বানিয়ে দিয়েছে?
অকাজের - ঐ বিচ্ছুগুলোর সব কথাই অকাজের, কাজের কিছুই নেই। কিন্তু একটা জীবনবোধ হয়েছে। সো কলড স্ট্যাটাস জিনিসটা আসলেই অনেক ঠুংকো।
২) বিরক্ত/অখুশী!
এধরণের মানুষেরা বেশিরভাগই বাবা ও মায়ের বন্ধু ছিল। বাবার বন্ধুরা মিলে একটা ছোটখাট গেট টুগেদার রেখেছিল আমাদের দেশ ছাড়ার আগে। সেখানে তাদের কিছু কথাবার্তা;
আংকেল - দোস্ত, তুই মাঝ বয়সে স্ট্র্যাগল করতে কেন যাচ্ছিস বলত? এখানে ওয়েল এসট্যাবলিশড। ওখানে গিয়ে শুরু থেকে শুরু করা কি সহজ মনে করিস?
বাবা - আরেহ তোরা ওভাবে দেখছিস কেন? আমি যখন এপ্লাই করেছিলাম তোদের দেখাদেখিই তো করলাম। এখন আমাকে সিলেক্ট করেছে, সুযোগটা হাতছাড়া করলে পরে যদি আফসোস হয়? যাই দেখি কি হয়। যদি ভালো না লাগে আবার চলে আসব।
মা - হ্যাঁ ভাই, আমরা তো জমি জমা বেচে যাচ্ছিনা যে আর ফিরতে পারবনা।
আন্টি - কিন্তু ভাবী আপনার মেয়ের কথা ভাবুন। ওর চোখমুখ তো শুকিয়ে গেছে বিদেশে যাবার নামে, ওখানে এডজাস্ট করতে পারবে তো?
মা - ওসব কিছুনা, ছোটদের কথায় অতো কান দিলে চলেনা। ওরা ভবিষ্যৎ বোঝেনা, আমাদেরই তো দেখতে হবে।
আংকেল - আপনারা ডিসাইড করেই ফেলেছেন, আর কি বলতে পারি? তবে একটা কথা বলে রাখি - ওখানে গিয়ে জীবন সহজ হবেনা ভাবী। কোন কাজের লোক পাবেন না। দেশের ডিগ্রীর ভ্যালু ওরা দেয়না, আবারো পড়াশোনা করতে হবে। যেয়েই ভর্তি হয়ে যেয়েন কোন একটা কোর্সে। পার্টটাইম জব, কোর্স, ঘরের কাজ সব সামলে শুরুর দিনগুলো অভাবে, অস্বস্তিতে কাটবে। কিন্তু একবার সেই ফেজটা পার করতে পারলে আর সমস্যা হবেনা ইনশাল্লাহ।
কাজের - ওনার সব কথাই কাজের। আসলেই বিদেশ জীবন অনেক স্ট্র্যাগলের। ওনার কথামতো অক্ষরে অক্ষরে নতুন দেশটিতে হোঁচট খেতে হয়েছে বহুবার। বারবার পড়ে যারা উঠে দাড়ানোর সাহস রাখেন, তাদেরই শুধু "প্রবাসী" হওয়া উচিৎ।
৩) উৎসাহিত/উদ্দীপিত!
প্রতিবেশীরা আমাদের বিদেশে যাবার ব্যাপারে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এক্সাইটেড ছিলেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল আমরা মিলিয়ন ডলার লটারি জিতে গিয়েছি। একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, কাছের দূরের অনেক আত্মীয় এমনকি রক্তের সম্পর্ক না থাকা পরিচিতরাও আমাদেরকে রিকোয়েস্ট করছিলেন বিদেশে নেবার ব্যাপারে। যেন আমরা চাইলেই যে কাউকে প্লেনে উঠিয়ে নিতে পারব! তেমনই এক প্রতিবেশী চাচী ও মায়ের কিছু কথার অংশ;
চাচী - ভাবী, বিদেশে গিয়ে মেয়ের স্কুলের কি করবেন?
মা - এখান থেকে টিসি নিয়ে নিয়েছি, ওখানে গিয়ে ভর্তি করাব।
চাচী - আপনার মেয়ের জীবন ওখানেই গড়ে উঠবে, মাশাল্লাহ। আপনার ভাইকে বলেছি কত বিদেশে যাবার কথা, সে তো কানেই তোলে না। আপনেরা গেলে আমাদেরও নিয়ে যাবেন ভাবী প্লিজ। দেশের অবস্থা তো দেখছেন। নিরাপত্তা নেই, কিছু না। ভীড়, গরম, এটা নেই সেটা নেই। বিদেশে তো কত ভালো ওয়েদার, ফ্রেশ খাবার, কাজের চাপ কম, ভালো স্কুল কলেজ। একবার কোনভাবে যেতে পাড়লে আমার আর বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা থাকত না।
অকাজের - এই গ্রুপের মানুষদের কোন কথাই প্রবাস জীবনে আমাদের কাজে আসেনি। বিদেশে জীবন সুন্দর তবে কাজের চাপ কম এটা একেবারে ঠিক না। আর ঐ সুন্দর জীবন পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক অসুন্দর দেখা লাগে।
৪) জ্ঞানী পাবলিক!
বাড়িতে যারা কাজ করত তাদের মতো বিজ্ঞ আর কেউ ছিলনা বিদেশের ব্যাপারে। নিচে মায়ের সাথে খালার তেমনই একটি কথোপকথন;
খালা - ভাবী, আপনেরা বহুত ভাগ্য কইরা প্রেথিবীতে আইছেন। দেশ বিদেশ দেইখা বেড়ান। আমি গরীব মানুষ, এক দেশত জনম ঐ দেশতই মরণ!
তয় ভাবী, আমারো মেলা আত্মীয় স্বজন বিদেশ থাহে। আমার গেরামের বাড়ির রহিমা খালার কথা কইছিলাম না? আমগো দুই বাড়ি পর থাহে? তার জামাইয়ের বোনের জামাই সৌদি গেল, তারপর মনোয়ারার দুলাভাই গেল, আর.....
মা - আচ্ছা বুঝলাম তো বিদেশে অনেকে আছেন তোমার। ভালো তো, তুমিও ঘুরে আসবে একদিন তাদের কাছে। এখন কাজে একটু হাতটা চালাও, দেখছই তো কত গোছগাছ করতে হচ্ছে!
খালা - কাম করতাছি তো ভাবী। আমি কইতাছিলাম সিনেমায় তো দেহি কেমন বরফ হৈয়া থাহে, শরীর জইমা যাইব না? আমি কৈ কি, আমার গেরাম থেইহা খাঁটি তেল আইনা দেই, তার মইধ্যে রসুন নিয়া মালিশ কইরলে গিট্টু ছুইট্টা যাইব। আর ঐহানে তো দেশের জিনিস পাইবেন না। আচার ছাড়া তো মিয়া (মেয়ে) ভাত/পরোটা কিছুই খায়না। আপনে কইলে আমি বানাইয়া দেই কয়েক পদের আচার?
মা - না না, ওসব কিছু করতে যেয়ো না প্লিজ। এসব নিয়ে যাওয়া অনেক ঝামেলার, আর ওখানে সব পাওয়া যায়, কোন চিন্তা করোনা।
কাজের - কানাডায় গিয়ে প্রথম প্রথম শীতে আসলেই খুব কষ্ট হতো গরম পানি/হিটার/ব্ল্যাংকেট/জ্যাকেট, গ্লভস ব্যবহারের পরেও। মায়ের হাত পা ব্যাথা হয়ে যেত অতিরিক্ত শীতে। তখন খালার রেসিপি মতো তেল মালিশ করে বেটার ফিল করেছিল।
অকাজের - বিদেশে সবকিছু পাওয়া যায়। এখানকার ছোট শহরগুলোর সুপারস্টোরেও এশিয়ান স্পাইস/ফুডের সেকশনস থাকে। তাছাড়া নানা ভারতীয়/বাংলাদেশী দোকান তো আছেই। প্রাণের আচার থেকে শুরু করে রুচি চানাচুর - ইউ নেম ইট, উই হ্যাভ ইট।
তবে যেটা কানাডায় পাবেন না সেটা হলো আবহাওয়া। রাস্তায় দাড়িয়ে, নীল আকাশের নিচে, কাঠফাটা রোদ/বৃষ্টিস্নাত বেলায় চানাচুর মাখা/কুলফি/ফুচকা ইত্যাদি খাবার যে আনন্দ, সেটা চার দেয়ালের মাঝে বসে তুষারপাত দেখতে দেখতে হয়না। বিষয়টা আসলে জমে না!
৫) প্রেরণাদায়ী!
আমার দাদার মতো জ্ঞান খুব কম মানুষের হয়। যেকোন বিষয় নিয়ে ওনার পড়াশোনা ও জ্ঞান ঈর্ষণীয়। নিচে তার কিছু কথা রইল, এগুলো এক সিটিং এ বলেন নি, একটু একটু করে একেক দিনে বলেছেন ঠিক সময় ও সুযোগ বুঝে।
বাবা শোন, এয়ারপোর্টে প্রচুর কারাপশন হয়। যদি কোনখানে আটকে এক্সট্রা টাকা চায় তাহলে বিনা বাক্যব্যায়ে দিয়ে দিবি। নাহলে হেনস্থা করবে, এমন প্যাঁচ লাগিয়ে দেবে যে আর যেতেই পারবিনা।
প্রথম প্রথম, মেয়ে স্কুল থেকে এসে কান্নাকাটি করবে। মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে ওর। সেসব দেখে দূর্বল হয়ে দেশে চলে আসবিনা। ওকে সময় দিস, সব ঠিক হয়ে যাবে।
তোর এখানে যা অর্থ/শিক্ষা/অভিজ্ঞতা সেসবের কিছুর মূল্যই ওদেশে পাবিনা। মানুষ শূন্য হয়ে পৃথিবীতে আসে, শূন্য হয়ে যায়। তুই জীবনের মাঝখানে হুট করে আবার শূন্য হচ্ছিস। এটা অনেক কষ্টকর হবে রে বাবা। কিন্তু তুই আগেও একবার নিজেকে গড়েছিস, আবার পারবি। তোর বউ আর বাচ্চার দায়িত্ব তোর কাঁধে। তাই কখনো ভেঙ্গে পড়বিন। দেশের মান ডুবিয়ে জীবনযুদ্ধে হেরে ফিরবি না।
কাজের - অবশ্যই দাদার সব কথাই প্রেরণার। সব প্রেডিকশন ঠিক ছিল। আমার আসলেই কানাডায় মানিয়ে নিতে কষ্ট হতো। তবে আমি বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করিনি, স্কুলেই ব্রেকের সময়ে কোথাও একটা লুকিয়ে অথবা রাতের আঁধারে কাঁদতাম। বাবা মায়ের স্ট্র্যাগল দেখতে দেখতে অনেক ম্যাচিউর হয়ে গিয়েছিলাম। আমি একটা এক্সট্রা সমস্যা হতে চাইনি তাদের জন্যে।
শেষ কথা: বিদেশে যাবার আগে সকল পরিচিত মানুষ যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দেখায় সেটার কারণে দেশ ছাড়া আরো কষ্টের হয়ে যায়। সত্যিই! ভীষন রকম মায়া ও ভালোবাসা আছে আমাদের দেশের মানুষের মনে। এটাই আমাদের সম্বল। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও আমি অনুভব করতে পারি - প্রযুক্তির চাপ, ভিনদেশী সংস্কৃতির অনুকরণ, দেশীয় মূল্যবোধের বিলুপ্তিতে সেসব কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে! আমার এই অনুভূতি মিথ্যে ও ভুল হোক, বাংলাদেশীরা নিজেদের সারল্য, মায়া, ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে বেঁচে থাকুক!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পূর্বের কুইজ: প্রশ্ন ছিল - বাড়ির সবাইকে মা এত কম সময়ে মানালো কি করে? সবচেয়ে কাছাকাছি উত্তর দিয়েছেন সবার প্রিয় ব্লগার শায়মা। তাকে অভিনন্দন এবং প্রাইজ হিসেবে একটি রবীন্দ্রসংগীত ও ডিনার সেট রইল।
শায়মা আপুর উত্তরটা ছিল - "নিশ্চয় তোমার পড়াশুনার দোহাই দিয়ে। সেখানে তুমি অনেক ভালো পড়ালেখা করতে পারবে। "
পারফেক্ট জবাব। ওখানকার এডুকেশন সিস্টেম কত ভালো, মেয়েদের নিরাপত্তা, বিদেশে পড়লে আরো ভালো বিয়ে হবে এসবও বলেছে। হাহাহা। বেসিক্যালি আমার কথা বলে মানিয়েছে। একবার দাদী যখন মত দিল পরিবারের সবার ভালো লাগুক না লাগুক বিষয়টাতে আপত্তি তোলেনি আর সেদিনের মতো।
এ পর্বের কুইজ - কুইজ সেভাবে নেই যেহেতু আমি নিজেই সবকিছু বর্ণনা করেছি। তবে এটা জানান যে কোন গ্রুপটি সবচেয়ে মজা লেগেছে? যার মন্তব্য/উত্তর আমার কাছে সবচেয়ে মজার লাগবে তার জন্যে থাকবে প্রাইজ।
ছবিসূত্র: অন্তর্জাল!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:৩৬