বোর্হেস সম্পর্কে কিছু কথা :
[ হোর্হে লুইস বোর্হেস যাকে বলা হয় লেখকদের লেখক। সাহিত্যের প্রায় সকল ক্ষেত্রে বিচরণ থাকলেও কেন জানি গল্পের জন্যেই বিশ্ববিখ্যাত। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপও ছিল বেশ। তবে তাঁর গল্পগুলো যে বিষয়, বিন্যাস, ও কৌশলগত দিক থেকে অন্যদের থেকে আলাদা এবং অবশ্যই মোহজাগানিয়া তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। প্যারাডক্স, গোলকধাঁধা, মিথ বা পুরাণকাহিনির বিনির্মাণ, চমৎকার প্লটবিন্যাস, দর্শন ও গণিতের আইডিয়া- এসবের জন্যেই তাঁর গল্পে একটা ম্যাজিকেল ফর্ম তৈরি হচ্ছে। আমাদের চেনাজানা আটপৌরে বাস্তবতা পরিহার করে মেটাফিজিক্যাল রিয়েলিটি নির্মাণ করছেন, চোখের সামনে আমরা ভেঙে যেতে দেখছি আমাদের পরিচিত দুনিয়ার কাঠামো, ফলে যেমন একটা ধাক্কা লাগে তেমনি আকর্ষণও করে বেশ। আরব্য রজনীর গল্পগুলির প্রতি তার মোহ সম্পর্কে আমরা জানি, একটা গল্প থেকে কিভাবে আরেকটা গল্প নির্মিত হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে একটার পর একটা আখ্যান ও উপাখ্যান সেই বিষয়টা দেখে বেশ চমৎকৃত হয়েছিলেন এবং নিজেও সেই ফর্মটা গ্রহণ করেছিলেন। এটা হয়তো আমাদের খুব চেনা, মহাভারতেও আমারা এমই একটি বিন্যাস দেখতে পাই। এই গল্পটা বিশেষ করে আরব্য রজনীর অনুকরণেই লেখা এবং এখানেও তাঁর প্রিয় বিষয় গোলকধাঁধা উপস্থিত। গল্পটা তাঁর El Aleph গ্রন্থ থেকে নেয়া। নরমান টমার ডি যোভান্নির ইংরেজি অনুবাদ অনুসরণে। মূল গল্পটি ইংরেজি অনুবাদে two kings and their two labyrinth নামে আছে।
জন্মগতভাবে আর্হেন্তিয় হলেও বলা হয়ে থাকে একমাত্র বোর্হেসই প্রকৃত বিশ্ব সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ]

দুই সম্রাট ও তাদের দুটি গোলকধাঁধা
বিশ্বস্ত কাহিনিকারগণের দ্বারাই এ ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ( যদিও কেবল আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞানী), অতীতে কোনও এক সময় ব্যাবিলনের দ্বীপগুলিতে এক সম্রাট ছিল, যে তার অধীনে সমস্ত স্থপতি এবং জাদুকরগণকে ডেকে এমন জটিল এক গোলকধাঁধা নির্মাণের কাজে লাগিয়ে দিল, কোনও বুদ্ধিমান লোকই যার ভেতরে প্রবেশের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করবে না, আর তা এতোই প্যাঁচালো যে যারা এর ভেতর প্রবেশ করবে পথভ্রষ্ট হবেই। এ উদ্যোগ ধর্মের বিরুদ্ধে একধরনের পরিহাস, কেননা, ধাঁধা এবং অলৌকিকত্বে কেবল ঈশ্বরেরই অধিকার রয়েছ, মানুষের নয়। সে সময়ে তার দরবারে কোনও এক আরব সম্রাটের আগমন ঘটল, এবং ব্যাবিলনের সম্রাট (অতিথির সরলতাকে পরিহাস করবার উদ্দেশ্যেই) তাকে তার গোলকধাঁধায় প্রবেশ করবার অনুমতি দিল, যেখানে সে রাত অবধি বিপর্যস্ত এবং হতবুদ্ধি অবস্থায় ঘুরে বেড়াল। অতঃপর সেই দ্বিতীয় সম্রাট ঈশ্বরের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল এবং কিছুক্ষণ পরই দরজার নিকটে পৌঁছে গেল। বহুকষ্টে সে তার ঠোঁটদুটিকে অসন্তোষ প্রকাশের থেকে নিবৃত্ত করল, তবে ব্যাবিলনের সম্রাটকে জানিয়ে রাখলো যে তার নিজের রাজ্যেও একটা গোলকধাঁধা রয়েছে, এবং ঈশ্বরের কৃপায়, কোনও একদিন সেও তার নিমন্ত্রাতাকে তা প্রদর্শন করে প্রীত হতে চায়। অতঃপর আরব্যদেশে ফিরে গিয়ে সে তার সেনাপতিদের এবং সৈন্যসামন্ত জড়ো করে ব্যাবিলনের রাজ্য আক্রমণ করল এবং ভাগ্য এতোটাই সুপ্রসন্ন ছিল যে সে দুর্গগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল, নিষ্পিষ্ট করে দিল এর জনগণকে, আর বন্দি করল স্বয়ং সম্রাটকে। ক্ষিপ্রগামী এক উটের পিঠে বেঁধে মরুভূমির মাঝে নিয়ে এল তাকে। তিনদিন পথচলার পর কয়েদকারী বলল, "হে সময়ের সম্রাট এবং শতাব্দির শিরোস্ত্রাণ! ব্যাবিলনে তুমি আমাকে প্রলুব্ধ করেছিলে তামার তৈরি অসংখ্য সিঁড়ি, দরজা এবং দেয়ালের এক গোলকধাঁধায়; এখন ঈশ্বর সুযোগ দিয়েছেন, আমার গোলকধাঁধা তোমাকে প্রদর্শনের, যাতে কোনও সিঁড়ি নেই উঠে যাওয়ার জন্যে, দরজা নেই ঠেলে বের হবার জন্যে, অতিক্রম করবার জন্যে নেই কোনও অন্তহীন সুড়ঙ্গ, নেই কোনও দেয়াল পথমাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবার জন্যে।
তারপর সে প্রথম সম্রাটের বাঁধন খুলে দিয়ে মরুভূমির ঠিক মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে গেল ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় মরবার জন্যে। গৌরব তারই যে মৃত্যুকে বরণ করে না বরং বেঁচে থাকে।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




