somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেহুলা, অর্ফিয়ুস ও সেলিম আল দীনের 'প্রাচ্য'

০২ রা অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'মনসামঙ্গল'-এ বেহুলার কাহিনির সাথে গ্রিকদের অর্ফিয়ুসের কাহিনির একটা মিল আছে। সাপের কামড়ে বেহুলার স্বামী লখিন্দরের মৃত্যু হলে ইন্দ্রপুরীতে দেবতাদের নাচ দেখিয়ে তুষ্ট করার বিনিময়ে ফিরিয়ে দেয়া হয় লখিন্দরের জীবন, আর অর্ফিয়ুসের স্ত্রী ইউরিদিসের সাপের কামড়ে মৃত্যু হলে, মৃত্যুপুরীতে হেডিসের দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনে দেবতাদের মুগ্ধ করে অর্ফিয়ুস ফিরে পায় তার স্ত্রীর জীবন। লখিন্দর এবং ইউরিদিস উভয়ের মৃত্যু হয় বিয়ের দিনেই। তবে মনসামঙ্গলের কাহিনিতে যেমন বেহুলার স্বামীর মৃত্যু, অর্ফিয়ুসের ক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীত। তবে মূল পার্থক্যটা অন্য জায়গায়, অর্ফিয়ুসের ক্ষেত্রে পরিণতিটা শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক। শর্ত ছিল পাতালপুরী থেকে মর্ত্যে ফেরত আসবার সময় অর্ফিয়ুস থাকবে ইউরিদিসের সম্মুখে এবং উভয়েই মর্ত্যে পৌঁছাবার আগে অর্ফিয়ুসের পেছনে ফেরা নিষেধ। অর্ফিয়ুস যখন মর্ত্যে প্রবেশ করল, পেছন ফিরে যখন ইউরিদিসের দিকে তাকাল, ইউরিদিস তখনও মর্ত্যে প্রবেশ করে নি। ফলে দেবতার শর্তভঙ্গ হল আর ইউদিস চিরজীবনের জন্যে উধাও হয়ে গেল।



দুটো কাহিনি পাশাপাশি রাখলে আরেকটা পার্থক্য দেখা যায়, চাঁদসওদাগর অবশেষে মনসার পূঁজা শুরু করে এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের মাঝে সেই থেকে মনসার আরাধনা শুরু হয়, এবং অর্ফিয়ুস শেষ জীবনে সূর্যদেবতা ছাড়া বাকি সব দেবতাদের অস্বীকার করা শুরু করে। এবং কালান্তরে ব্যর্থপ্রেমিকগণের একরকম উপাস্য হয়ে উঠে অর্ফিয়ুস। এখানে মনসামঙ্গলের কাহিনিতে যেমন দেবতার নিকট মানুষের নতি স্বীকার দেখানো হয়েছে অর্ফিয়ুসে ঠিক উল্টো। এ বিষয়ে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটা কবিতা আছে, 'বেহুলার প্রতি অর্ফিয়ুস' শেষ কয়েকটা পঙক্তির উদ্ধৃতি দেয়া যায়-

বেহুলা তোমার জয়, স্থূল সফলতার গৌরব
শিল্প নয়। তুমি
মানব চরিত্রে কালো কলঙ্ক এঁকেছো
দেবতাকে মহৎ করো নি।
চম্পকনগরে আজ সুখসিন্ধু, কেন সে সিন্ধুর জল
বিস্বাদ, অপেয়, তুমি জানো।

নাচনী, তোমার জন্য বীণাবাদকের দুঃখ হয়।

অবশ্য চাঁদসওদাগরকে বিবেচনায় রাখলে অর্ফিয়ুসের ঔদ্ধত্য আমরা তাঁর মাঝেও দেখতে পাই। শেষপর্যন্ত মনসার পূজা করলেও, সে পূজা নিবেদন করেছিল মনসার প্রতিমার দিকে উল্টো হয়ে ঘুরে। তবে তাতেই মনসা খুশি হয়। এক্ষেত্রে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের old man and the sea উপন্যাসের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তি, মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজিত হয় না। অর্ফিয়ুস বা চাঁদসওদাগর অন্তত শেষ পর্যন্ত দেবতার কাছে পরাজয় স্বীকার করেনি। যেটা হয়তো করেছিল বেহুলা। বেহুলাকেই মূল চরিত্র হিসেবে ধরে নিলে মনসামঙ্গল সেই পরাজয়েরই আখ্যান।

এবার আরেকটি সাহিত্যকীর্তির কথা বিবেচনা করা যায়, যার জন্যেই আসলে বেহুলা-অর্ফিয়ুস নিয়ে এই আলোচনা। সেলিম আল দীন রচিত নাটক 'প্রাচ্য'। 'প্রাচ্য' নাটকেও মনসামঙ্গলের কাহিনির পুনঃনির্মাণ দেখা যায়। কিন্তু ঠিক মনসামঙ্গলের মতো নয় বরং অর্ফিয়ুসের মতো এই নাটকেরও ট্র্যাজিক পরিণতি। আবার ঠিক যেন অর্ফিয়ুসের মতোও নয়। সেলিম আল দীন নাটকের কাহিনিকে নামিয়ে এনেছেন নিম্নবিত্তের বাঙালি সমাজজীবনে। বাসার রাতে সাপের কামড়ে নববধুর মৃত্যুকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয় নাটকের প্রোটাগনিস্টকে (নামটা ঠিক মনে আসছে না!)। এবং নববধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঘরের মেঝে খুড়ে সাপ বের আনলেও শেষ পর্যন্ত সাপকে তার ক্ষমা করে দিতেই হয়, এখানে এই ক্ষমা করে দেয়াটা যেন বাধ্যতামূলক এবং এর মাঝে নায়কোচিত গৌরব দেখি না বরং পরাজয় দেখা যায়। চরিত্রটি শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে না, অর্ফিয়ুসের মতো মহানায়কও হয়ে উঠতে পারে না। এই যে ক্ষমা করে দেয়া, প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকা, এ তার মহানুভবতার পরিচয়তো নয় বরং কুরস্কারাচ্ছন্ন মননের প্রতিফলন। নাটকে শেষ পর্যন্ত কোনও মহাকাব্যিক বীরত্বও দেখা যায় না যেই কারণে। এখানেই মনে হয় সেলিম আল দীনের বিশেষত্ব দেখা যায়। পুরাণ কাহিনির যেই বিনির্মাণ আমরা নাটকে দেখি সেটা কেবল আঙ্গিকগত নয় বরং সেলিম আল দীন যেন আগাগোড়া মৌলিক হয়ে উঠেছেন, সেটা কিভাবে এক দুই কথায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে এই নাটকের উৎস যদি খুঁজতে যাই সেটা বাঙালির প্রান্তিক সমাজজীবনেই খুঁজতে হবে। ইউরোপিয়ান অ্যারিসটোক্র্যাট সাহিত্যে তা পাওয়া সম্ভব নয়। মোটাদাগে এই বিষয়টা হয়তো চোখে পড়বে না, এখানে সাদৃশ্যটাই বৈসাদৃশ্য হিসেবে চলে আসছে, এবং এই বৈসাদৃশ্য কাহিনিতে নয় কাহিনির অন্তর্গত কোনও এক গোলকধাঁধায়, কিন্তু তিনটি ভিন্ন চরিত্রের জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, তাহলে হয়তো কিছুটা আন্দাজ করা যায়, এক জায়গায় যেখানে বিজয়টাই পরাজয়, অন্য জায়গায় পরাজয়টাই গৌরব, আর অপরটিতে পরাজয়টা কেবল পরাজয়ই রয়ে যাচ্ছে....

( *বেহুলা, লখিন্দরের কাহিনির উৎস হয়তো, মহাভারতে উল্লেখিত সাবিত্রি-সত্যবানের উপাখ্যান। তবে সে অন্যত্র আলোচনার বিষয়। এখানে আর তার উল্লেখ করলাম না।)

* ছবি : Orpheus by James Barry, 1792
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৫:০০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×