আমাদের সময় ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট পড়া শুরু করতো সাধারণত নবম শ্রেণীতে উঠলে। এর আগেও অনেকে পড়তো। তবে তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই হাতেগোনা।
নবম শ্রেণীতে উঠলে বোর্ড পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হতো । সেই সময় থেকেই কঠিনভাবে শুরু হতো এসএসসি পরীক্ষায় ভালো করার জন্য প্রস্তুতি । এই প্রস্তুতির সহায়ক হিসেবে স্কুলের সেরা শিক্ষকদের কাছে ব্যাচে প্রাইভেট পড়াটাই ছিল একটি প্রধান অস্ত্র ।
তবে অভিভাবকদের আর্থিক স্বচ্ছলতার উপর নির্ভর করে এটা করা সম্ভব ছিল । কেননা গ্রামের স্কুলের ক্ষেত্রে দেখা যেত বেশিরভাগ অভিভাবকেরই অতিরিক্ত অর্থ খরচ করার সামর্থ্য ছিল না।
ফলে অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারতো না । এরকম অনেক ঘটনার মধ্যে আমি নিজেও একটা ঘটনার সাক্ষী ।
আমি ছাত্র হিসেবে মোটামুটি মানের ছিলাম। নবম শ্রেণীতে ওঠার পরে সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে বিজ্ঞান বিভাগে পড়বো। এই সিদ্ধান্তটা এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে জীবনের অন্যতম একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল ।
আমার উচিত ছিল মানবিক বিভাগে পড়া । মানবিক বিভাগে পড়লে হয়তো আমার জীবনের ইতিহাসটা অন্যদিকে মোড় নিতে পারতো ।
সে যাই হোক । যে বিষয়ের উপর বলছিলাম । আমাদের ক্লাসে যারা মোটামুটি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিল তারা সাধারণত দুইজন স্যারের কাছে পড়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তো । একজনের নাম ছিল বাবু সুধীরচন্দ্র পাল । আরেকজনের নাম ছিল আব্দুস সালাম বেপারী।
আব্দুস সালাম বেপারী একজন বিএসসি টিচার ছিলেন। সেই আমলে গ্রামের স্কুলগুলোতে বিএসসি টিচারদের আলাদা একটা সুনাম ও মূল্যায়ন ছিল । এই কারণে সাইন্সের ছাত্রদের অনেকরই আগ্রহ থাকতো বিএসসি স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়া । আমাদের স্কুলের বাবু সুবীর চন্দ্র পাল বিএসি টিচার ছিলেন না। অন্য দিকে আব্দুস সালাম ছিলেন বিএসসি টিচার । আমরা যখন নবম শ্রেণীতে পড়তাম তখন উনাদের কাছে ব্যাচে প্রাইভেট পড়লে প্রতি মাসে উনাদেরকে দিতে হতো নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন ১০০ টাকা করে আর দশম শ্রেণীতে উঠলে ১৫০ টাকা করে ।
এতদিন পর আমার কাছে মনে হচ্ছে এই টাকাটা হয়তো খুব বেশি ছিল না । কিন্তু তারপরেও আমাদের অনেক অভিভাবকেরই এটা বহন করার মত সামর্থ্য ছিল না ।
সে যাই হোক একদিন বারান্দায় সুধীর স্যার আমাকে ডাক দিলেন, এই শুনে যা ।
আমি খুব দ্রুত ওনার কাছে গিয়ে আদাব দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি বললেন, আমার কাছে পড়তে আসিস না কেন? আগামীকাল থেকে পড়তে আসিস।
আমি চুপ করে রইলাম । আসল ঘটনা তো উনাকে খুলে বলা যাবে না। টপ সিক্রেট।
একেই ঘটনা অন্য আরেকদিন ঘটল । আব্দুস সালাম বেপারী স্যার আমাকে ডাক দিলেন। বললেন, এই শুনে যা আমার কাছে পড়তে আসিস না কেন?
আগামীকাল থেকে পড়তে আসবি।
আমি তার কাছেও নিরবে দাঁড়িয়ে রইলাম । উনি কিছু বুঝতে পারলেন কিনা জানিনা।
সে যাই হোক । আসলে আমার বাবার সমর্থ্য ছিল না । কেননা আমরা ছিলাম অনেকগুলো ভাই বোন। তাদের পড়াশোনার খরচ চালানোর মত আর্থিক অবস্থা উনার ছিল না।
সেই কারণে আমার আর উনাদের দুজনের কারো কাছে পড়তে যাওয়া হয়নি । ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হয়েছিল । আমি ক্রমেই উনাদের ক্লাসের বাকি সবার চেয়ে ফলাফল খারাপ করতে থাকলাম ।
যার চূড়ান্ত প্রতিফলন দেখা গেল ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টে। ফাইনাল পরীক্ষায় আমার সহপাঠীদের কেউ কেউ স্টার মার্ক পেলেও আমার জন্য ৭০% হয়ে উঠল নিতান্তই কঠিন । উত্তম ফলাফলের তালিকায় আমার নাম ছিল না ।
এতদিন পরে আমি বুঝতে পারলাম ঘটনাটা এবং আমার খুবই আফসোস হতে থাকলো ।।
সেই সময় আমাদের স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সিরাজ ভাই নামে একজন ছিলেন । যিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক ও বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি ।
একদিন তার সাথে আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললাম। উনি আমাকে বললেন , এরকম হলে তো ক্লাসের সবাইকেই ফ্রি স্টুডেন্টশিপ দিতে হতো। সবাইকে সেটা দিলে স্কুল চলতো
কিভাবে?
আমি বললাম, সিরাজ ভাই, আমি আসলে সেটা বলতে চাইনি । আমি বলতে চেয়েছি যাদের একটু ভালো ফলাফল করার সম্ভাবনা আছে তাদেরকে কোন না কোন ভাবে একটা আয়ের সুযোগ করে দেয়া যাতে তারা প্রাইভেট পড়তে পারে। যেমন- যারা মোটামুটি ভালো ছাত্র তারা কারো ছেলেমেয়েদেরকে পড়াতে পারতো এবং সেখান থেকে হয়তো মাসে দেড়শ,দুশ টাকা ইনকাম করতে পারতো । সেই ইনকামের টাকা দিয়ে তারা ব্যাচে পড়তে পারতো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৫১